ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ঘটনায় আহত কাউকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৯ আগস্ট ২০১৮

দুর্ঘটনায় আহত কাউকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ও সহায়তাকারীর সুরক্ষায় প্রণীত নীতিমালার দুটি অংশে আদালতের পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। নীতিমালায় বলা হয়েছে আহত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতা সম্পন্ন হাসপাতাল কোন অবস্থাতেই চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেরত বা স্থানান্তর করতে পারবে না। আহত ব্যক্তি চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিস্ক ও সম্মতি দিতে সক্ষম হলে তার জীবন রক্ষার্থে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তার সম্মতি নিতে হবে। আহত ব্যক্তি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে অভিভাবকের সম্মতি নিতে হবে। অভিভাবক না থাকলে বা না পাওয়া গেলে শল্য চিকিৎসা জরুরী হলে তার সম্মতি আছে বলে ধরে নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। জরুরী শল্য চিকিৎসার কারণে আহত ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা থাকলে বা জীবনহানি ঘটলে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত জারি করা রুল ‘যথাযথ ঘোষণা করে’ রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিবকে এ গেজেট প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত এ নীতিমালাই আইন হিসেবে বিবেচিত হবে। এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক তিন উপাচার্যসহ অবসরপ্রাপ্ত ১৯ শিক্ষককে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী তাদের অবসরকালীন ছুটি (পিআরএল) ও পেনশন সুবিধা দিতে হাইকোর্টের রায় আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে। অন্যদিকে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পাঠানোর জন্য হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। চেম্বার জজ আদেশ স্থগিত না করে আবেদনের বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়েছে। বুধবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ, চেম্বার জজ ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ও সহায়তাকারীর সুরক্ষায় প্রণীত নীতিমালার দুটি অংশে আদালতের পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এই রায় দেয়। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী রাশনা ইমাম, আনিতা গাজী রহমান ও শারমিন আক্তার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল কাজী জিনাত হক। রায়ের পর আইনজীবী রাশনা ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত জারি করা রুল ‘যথাযথ ঘোষণা করে’ রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের করা এ সংক্রান্ত নীতিমালার দুটি অংশে আদালতের পর্যবেক্ষণ যুক্ত করে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছে। দুই বছর আগে ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি গুরুতর আহত ব্যক্তিদের জরুরী চিকিৎসাসেবা দিতে দেশের সরকারী-বেসরকারী সব হাসপাতালকে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং চিকিৎসা না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোথায় অভিযোগ করবে সে বিষয়ে নীতিমালা করতেও সরকারকে নির্দেশ দেয়। রুলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী চিকিৎসাসেবা দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সৈয়দ সাইফুদ্দিন কামাল নামের এক ব্যক্তির জনস্বার্থে করা রিট আবেদনে ওই নির্দেশনা দিয়েছিল আদালত। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি আরাফাত নামের এক ব্যক্তি বাসে উঠতে গিয়ে পা পিছলে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন। তাকে নিকটস্থ তিনটি হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এরপর পুলিশের সহযোগিতায় তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান। ওই ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে করা রিট আবেদনটিতে বলা হয়, এ ধরনের দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিদিনই চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মারা যাচ্ছে সাধারণ নাগরিক। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা প্রয়োজন। আদালত রুলের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারির পাশাপাশি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা ২০১৪-১৬ অনুযায়ী সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে জরুরী চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলে। এছাড়াও জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদান ও চিকিৎসা পেতে বাধা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোথায় অভিযোগ করবেন সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরি ও এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী যানবাহন দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী চিকিৎসাসেবার স্বার্থে সরকার ‘জরুরী স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তাকারী সুরক্ষা প্রদান নীতিমালা-২০১৮’ প্রণয়ন করে। নীতিমালার ‘প্রযোজ্যতা’ অংশে বলা হয়েছে, দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী সেবা প্রদান’ অংশে বলা হয়েছে, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষায় তাৎক্ষণিকভাবে (গোল্ডেন আওয়ার এর মধ্যে) তাকে নিকটতম হাসপাতালে প্রেরণ এবং জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। আইনী জটিলতার সম্ভাবনা বিবেচনায় চিকিৎসাসেবায় দেরি করা যাবে না এবং আহত ব্যক্তির আর্থিক সক্ষমতা বিষয় বিবেচনা না করে বেসরকারী হাসপাতালগুলো কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সসেবিলিটির (সিএসআর) আওতায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করবে। নীতিমালার ‘চিকিৎসা সেবা প্রদানে স্থানান্তর ’ অংশে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ (ইনটিগ্রেটেড) চিকিৎসাসেবা সুবিধা বা সক্ষমতা না থাকলে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যাবলী লিপিবদ্ধ করে ( গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা দেয়ার লক্ষ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালে নিজ দায়িত্বে স্থানান্তর করবে। ‘উপযুক্ত সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতাল কর্তৃক চিকিৎসা প্রদানের বাধ্যবাধকতা’ অংশে বলা হয়েছে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতা সম্পন্ন হাসপাতাল কোন অবস্থাতেই চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেরত বা স্থানান্তর করতে পারবে না। ‘চিকিৎসাধীন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ’ অংশে নীতিমালায় বলা হয়েছে, আহত ব্যক্তি চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক ও সম্মতি দিতে সক্ষম হলে তার জীবন রক্ষার্থে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তার সম্মতি নিতে হবে। আহত ব্যক্তি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে অভিভাবকের সম্মতি নিতে হবে। অভিভাবক না থাকলে বা না পাওয়া গেলে শল্য চিকিৎসা জরুরী হলে তার সম্মতি আছে বলে ধরে নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। জরুরী শল্য চিকিৎসার কারণে আহত ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা থাকলে বা জীবনহানি ঘটলে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। নীতিমালার ‘অবহেলা বা শৈথিল্য প্রদর্শন’ অংশে বলা হয়েছে, জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির অবহেলা বা শৈথিল্য অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত হবে; অবহেলা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করলে নিবন্ধন বা লাইসেন্স বা অনুমতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিধিমত প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ‘জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সেল গঠন’ অংশে বলা হয়েছে, সরকার এ নীতিমালা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সেল গঠন করবে; এই সেল নীতিমালার কার্যরিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে উপযুক্ত সুপারিশ প্রণয়ন ও মনিটরিং করবে এবং মনিটরিংয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা শৈথিল্য চিহ্নিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা বিচার্য হবে। ‘আহত ব্যক্তির তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহকরণ’ অংশে বলা হয়েছে, সব হাসপাতাল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাসেবা প্রদান সংক্রান্ত তথ্য নির্ধারক ছক অনুযায়ী ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রেরণ করবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর তা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে।
×