ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম মুুজিবের জন্মদিনের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

কোন ক্রাইসিসে বঙ্গমাতার সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৯ আগস্ট ২০১৮

কোন ক্রাইসিসে বঙ্গমাতার সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনসহ জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গমাতার পরামর্শ জাতির পিতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রেরণা, শক্তি এবং সাহসের এক উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা। স্বামীর সকল সিদ্ধান্তে মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন তিনি। স্বাধীনতার সংগ্রামের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার পেছনে শেখ ফজিলাতুন্নেসার অবদান ছিল। জাতির পিতা আমার মায়ের মতো একটা সাথী পেয়েছিলেন বলেই সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। কারণ যে কোন ক্রাইসিসে বঙ্গমাতার সিদ্ধান্ত দেয়ার অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল। বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৮তম জš§বার্ষিকী উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গমাতা সম্পর্কে আরও বলেন, বঙ্গমাতার সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানে। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও প্রচার বিমুখ ছিলেন। তাই বঙ্গমাতার অবদান লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, বেগম মুজিব খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান। আমার দাদা-দাদির কাছে বেড়ে ওঠার সময় অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে সাহস, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গমাতাকে প্রধানমন্ত্রী স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ বাঙালী নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজখবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা আম্মা নেতাকর্মীদের পৌঁছে দিতেন। আব্বা কারাবন্দী থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা যোগাড় করতেন। বাবার (বঙ্গবন্ধু) কোন কাজেই মা প্রতিবন্ধক নয় বরং সহায়ক ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা চাইলে স্বামীকে সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করে এ সময় আক্ষেপের সুরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবাকে কখনও টানা দু’বছরও আমাদের মাঝে পাইনি। আমার মা এবং বঙ্গবন্ধু মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একে অপরের পরিপূরক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীবনের একটি বড় সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর অবর্তমানে একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন শুরুর পর দেশমাতৃকার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জাতির পিতার সহযোদ্ধা বেগম মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও কিছু উপাখ্যান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালীকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাক সামরিক সরকার। ছয় মাস পর্যন্ত তাঁর কোন হদিস ছিল না, আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না। এরপরে কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখান, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। আম্মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোন মুক্তি হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি তারা বলেছেন, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাওনা? আম্মাকে বলেছেÑ ভাবি আপনি কিন্তু বিধবা হবেন।’ তিনি বলেন, আমার মা তখন কঠিন স্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৩ জন আসামির কী হবে? বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, এর আগে, ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির জন্য সারাদেশে জনসভা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আটবার গ্রেফতার হন। তখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার ৬-দফাকে ৮-দফায় রূপান্তরের চেষ্টা বেগম মুজিবের জন্য ভেস্তে যায়। ৬ দফা আন্দোলনের সময় সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারাবন্দীদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতাল সফল করা, সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। তিনি নিজ বাসা থেকে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সেখান থেকে স্যান্ডেল আর বোরখা পরে জনসংযোগে বেরিয়ে পড়তেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় বেগম মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্ষুর আড়ালে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে ছাত্রদের তিনি নির্দেশনা দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করেও অর্থ জুগিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ১৪ খ-ের প্রকাশনা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এসবির ৪৭টি ফাইল পাওয়া গেলেও বেগম মুজিবের গোপন তৎপরতা নিয়ে কোথাও কোন রিপোর্ট নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেগম মুজিব প্রকৃতই একজন গেরিলা ছিলেন। ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই দিন নানা জনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে। আম্মা তখন তাঁকে একটি ঘরে বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়ে মোড়া টেনে মাথার কাছে বসে বঙ্গবন্ধুকে কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করে রাখতে বললেন। তারপর আম্মা বললেন, ‘তোমার যা মনে আসে তাই তুমি বলবে। তুমি রাজনীতি করেছো, কষ্ট সহ্য করেছ, তুমি জান কি বলতে হবে। কারও কথা শোনার দরকার নাই।’ তিনি সেদিন এ ভাষণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘এই লাখো জনতা যেন হতাশ হয়ে না যায়। আবার পাকিস্তানীরা যেন গোলাগুলি করে এদের শেষ করে দিতে না পারে।’ বঙ্গবন্ধুকে বেগম মুজিব যখন এই পরামর্শ দেন তখন সেই ঘরে শেখ হাসিনাই কেবল সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা জানান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দী। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার ‘মা’ নিজের জন্য কখনও কিছু চাননি। অথচ সারাজীবন এই দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তিনি এ দেশকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। আব্বার সঙ্গে থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন- এদেশের মানুষ ভাল থাকবে, সুখে-শান্তিতে বাস করবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবার পাশে থেকে সে স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছেন। তাঁর মায়ের আত্মত্যাগ বাবাকে এগিয়ে নিয়েছে বলেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিতে পেরেছেন। কাজেই এ স্বাধীনতায় তাঁর মায়ের অবদান অবিস্মরণীয়’- বলেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দলের কাজকর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামে নিজের সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতেন মা। মা-বাবা কখনো আমাদের অভাব বুঝতে দেননি। কৌশলে সেসব অভাব মেটাতেন আর আমাদের ভিন্নভাবে বোঝাতেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আব্বা বারবার কারাগারে যাবার ফলে এমনও দিন গেছে যে বাজার করতে পারেননি। আমাদের বলেননি, আমার টাকা নাই। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে আচার দিয়ে বলতেন, চলো আমরা আজ আমরা খিচুড়ি খাব। তিনি বলেন, ‘বাবা জেলে, সংসার ও সংগঠনের জন্য টাকার যোগাড় করতে গিয়ে মা বাড়ির ফ্রিজটি পর্যন্ত বিক্রী করে দিচ্ছেন অথচ বললেন, ঠা-া পানি খাওয়া ভাল নয়। শরীর খারাপ হতে পারে। কাজেই এর আর দরকার নেই। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশের অবস্থা বর্ণনা, সংগঠনের অবস্থা অবহিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে দলের নেতাকর্মীদের কাছে তা হুবহু পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ স্মরণ শক্তির অধিকারী বেগম মুজিবকে ‘জীবন্ত টেপ রেকর্ডার’ বলেও এ সময় শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভাল ছিল। বাবাকে কোন পরামর্শ দিতে হলে আমিই চলে যেতাম মা’র মিশন নিয়ে। বাবা ভিড়ের মধ্যেও আমাকে একবার দেখলেই বুঝতে পারতেন ‘জরুরী কোন মেসেজ আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গমাতাই বোধ হয় সবচেয়ে আগে জানতেন, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে। স্কুল কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও বেগম মুজিব স্বশিক্ষিত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আম্মার উৎসাহেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন এবং জাতির পিতার ডায়েরিগুলো বঙ্গমাতাই সংরক্ষণ করে রাখেন, যা পরবর্তীতে পুস্তকাকারে প্রকাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গমাতার অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, তিনি কোন দিন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকতে চাননি, যদি ছেলে-মেয়েরদের চোখ উপরে উঠে যায়। বঙ্গমাতা বিলাসিতাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। ছেলেমেয়েদের সেই আদর্শেই গড়ে তোলেন। আব্বা পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী ছিলেন। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে বিত্ত-বিলাসিতার মোহ কখনও তৈরি হয়নি। আমার মায়ের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বাবার আকাক্সক্ষা ছিল ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
×