রুমেল খান ॥ মানুষের ক্ষুদ্র জীবনে যত সুখময় ঘটনা ঘটে, জন্মদিন হচ্ছে তার একটি। তবে জন্মদিনের সময় বা আগে যদি কোন সুখবর পাওয়া যায় তাহলে জন্মদিনটা হয় খুবই আনন্দময়। মনে হয়, ওটাই হচ্ছে জন্মদিনের সেরা উপহার। এমনই এক ‘সেরা’ উপহার পেয়েছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। ভারোত্তোলনের এই তারকা কন্যার জন্মদিন ছিল ৭ আগস্ট, মঙ্গলবার। এদিনই তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কাছ থেকে পেয়েছেন মস্ত এক শুভ বার্তাÑ আসন্ন এশিয়ান গেমসের মার্চপাস্টে তিনিই বহন করবেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
যদিও বিওএ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি এ বিষয়ে। ‘বিওতে যাওয়ার পর আমাকে একজন বলেছেন যে, তুমি বাংলাদেশের পতাকা বহন করবে। আমার কাছে এটা বড় একটা পাওয়া। কারণ সবার সামনে থেকে আমি বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে দাঁড়াব। এশিয়ান গেমসের মতো এত বড় আসরে প্রথমবার খেলতে যাচ্ছি। এসএ গেমসে স্বর্ণ জিতে দেশের পতাকা ওড়াতে পেরেছি। এশিয়ান গেমসে প্রথমবারই মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করব। সত্যিই আমি খুব গর্ববোধ করছি। আমার জš§দিনের সবচেয়ে বড় উপহার এটাই।’ আগামী ১৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও পালেমবাংয়ে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ান গেমসের অষ্টাদশ আসর।
সোমবার দিবাগত রাত ১২টায় কাজিনরা সারপ্রাইজ দেন সীমান্তকে। তারাই কেক কেটে জন্মদিন পালন করেছেন সীমান্তর। এছাড়া ফোনে এবং এসএমএসে বন্ধু, আত্মীয়, শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা পেয়েছেন। ‘আসলে ঘটা করে সেভাবে জন্মদিন কখনই পালন করা হয় না। একান্তই ঘরোয়াভাবে সাদামাটা জন্মদিন পালন করে থাকি। তবে এবার সেটা করতে পারিনি। কারণ আমার এক কাজিনের বিয়ে। এ নিয়ে একটু ব্যস্ত। তবে সোমবার রাতে আমার অন্য কাজিনরা কেক কেটে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। কাজিনের বিয়েটা হয়ে গেলেই আজ রাতে (মঙ্গলবার) কিছু হতে পারে।’ জনকণ্ঠকে জানান সীমান্ত।
যদিও প্রথমে শোনা গিয়েছিল শূটার আব্দুল্লাহ হেল বাকীই পতাকাবাহক হবেন এশিয়ান গেমসে। এর আগে ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে পতাকা বহন করেছিলেন বাকী। একই সঙ্গে ২০১৬ সাফে স্বর্ণজয়ী শূটার শাকিল আহমেদের নামও শোনা যাচ্ছিল। তবে তারা কেউই নন, চূড়ান্ত করা হয় সীমান্তর নামটিই।
এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। গেমসের উদ্বোধন হবে জাকার্তায়। এই শহর থেকে পালেমবাংয়ে যেতে বিমানে লাগে একঘণ্টা কিন্তু শূটিং ইভেন্ট হবে পালেমবাংয়ে। বাংলাদেশের সব শূটাররা সরাসরি এই শহরে যাবেন। এছাড়া গত এসএ গেমসে দুটি স্বর্ণজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা এবার নেই এশিয়াডের দলে। আর এ কারণেই বাংলাদেশের পতাকা বহন করতে মাবিয়াকে বেছে নিয়েছে বিওএ। আজ সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন তারা।
১৪টি ডিসিপ্লিনে বাংলাদেশের ১১৮ এ্যাথলেট অংশ নেবেন এবারের এশিয়ান গেমসে। এদের সবার সামনে থাকবেন মাদারীপুরের মেয়ে সীমান্ত। উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষের এই শিক্ষার্থী জনকণ্ঠকে আরও জানান, ‘আমার পরিবারের সবাই যখন শুনলো আমিই পতাকা বহন করব তখন তারা খুবই খুশি হয়েছে। আমিও ভীষণ আবেগে আপ্লুত হয়েছি। বলতে পারেন এটাই আমার এবারের জন্মদিনের স্পেশাল এবং সেরা উপহার। কয়েক বছর ধরেই বিওএতে গেলে সবাই বলত, তুমি কবে পতাকা বহন করবে? তাদের এই চাওয়া যে এভাবে ফলতে যাচ্ছে এটা ভাবতেই পারিনি।’
তবে এশিয়ান গেমসে পদকের প্রত্যাশা করছেন না সীমান্ত। তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য নিজের ও জাতীয় সেরা রেকর্ড ১৮০ কেজির বেশি ভার তোলা। আরও বেশি পারতাম, কিন্তু ফেডারেশন যদি ভাল ও যোগ্যতাসম্পন্ন কোচ দিত তাহলে নিশ্চয়ই পারতাম।’
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ভারতের গুয়াহাটি। ভোগেশ্বরী ফুকানানি ইনডোর স্টেডিয়াম। দক্ষিণ এশিয়ান গেমস। ভারোত্তোলনে মেয়েদের ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণী। স্বর্ণপদক জিতলেন যিনি তিনি পদক নিতে পুরস্কার মঞ্চে দাঁড়ালেন। মাইকে বাজছে জাতীয় সঙ্গীত, পাশে উড়ছে জাতীয় পতাকা। গলায় পদক পরে পতাকার দিকে তাকিয়ে স্যালুট তুলে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কেঁদে যাচ্ছেন একটানা। ওই আসরে বাংলাদেশের জন্য প্রথম স্বর্ণপদক এনে দেন তিনিই। তার নাম সীমান্ত। মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
কেন এমন কান্না? ‘কনুইয়ে ফ্র্যাকচারের কারণে ডাক্তার বলেছিল আপাতত কিছুদিন খেলা উচিত হবে না। কিন্তু সেই হাত নিয়েই খেলে জিতেছি দেশের এবং আমার প্রথম স্বর্ণপদক। আশাই ছিল না পদক জেতার।
এরপর যখন পুরস্কার মঞ্চে উঠি, মাইকে জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল, পাশে জাতীয় পতাকা উড়ছিল। সবকিছু মিলে কান্না থামাতে পারছিলাম না।’ ১৯ বছর বয়সী সীমান্তর ভাষ্য।
এর আগে ২০১৩ সালে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক জিতেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে উজবেকিস্তানে আফ্রো-এশিয়া কাপেও রৌপ্যপদক জিতেছিলেন। একই বছর থাইল্যান্ডে কিংস কাপে জিতেছিলেন তাম্রপদক। স্বপ্ন দেখেন একদিন অলিম্পিকে খেলতে যাবেন।
‘কষ্ট’ শব্দটার সঙ্গে সীমান্তর পরিচয় শৈশব থেকেই। ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সেক্রেটারি উইং কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিন মাবিয়াকে আসা-যাওয়ার ভাড়া দিতেন নিজের পকেট থেকে। টাকার অঙ্কটি খুবই ক্ষুদ্র, মাত্র ৫০ টাকা। কিন্তু মাবিয়ার জন্য সেটাই ছিল অনেক বড় কিছু। দোকানি বাবা কি যে কষ্ট করে তাদের তিন ভাইবোনকে বড় করেছেন সেটা ভেবে আজও শিউরে ওঠেন এই নারী ভারোত্তোলক।
খেলাটিতে শরীর থেকে যে প্রাণশক্তি ক্ষয় হয়, সেটা পোষাতে রোজ খাদ্য-তালিকায় আমিষের উপস্থিতি দরকার। দুপুরে মাছ হলে রাতে মাংস, কিংবা দুপুরে মাংস হলে রাতে মাছ। সকাল-বিকেল দুধ-ডিমের খরচ তো আছেই। কিন্তু মাবিয়ার বাবা কষ্ট হলেও মেয়েকে এগুলো জুগিয়ে গেছেন। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের খেলাধুলাকে নিরুৎসাহিত করার যে প্রবণতা আছে, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা হঠাৎ বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনের ব্যঙ্গোক্তি... এগুলো মোকাবেলা করেই সীমান্ত আজ এই অবস্থানে।
বাবা খিলগাঁওয়ে মুদির দোকানি। চালাতেন সিএনজি অটোরিকশাও। আর্থিক প্রতিকূলতায় একসময় বন্ধ হয়ে যায় সীমান্তর লেখাপড়া। মামা বক্সিং কোচ শাহাদাত কাজী জোর করেই ভাগ্নীকে ভারোত্তোলন অনুশীলন করাতে শুরু করেন। সেই ভারোত্তোলন পাল্টে দিয়েছে সীমান্তর জীবন। সেই খেলার কারণেই আগামী এশিয়াডের মার্চপাস্টে তার হাতেই উঠতে যাচ্ছে লাল-সবুজের পতাকা।