ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৮ আগস্ট ২০১৮

নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে

রাত ঘনায় আঁধারের ডানা মেলে। জোনাকীরা চলে চুপি চুপি। ভীরু ভীরু পায়ে আসে পথিক। পান্থজনের সখা হয়ত সে, হয়ত নয়। তবু পদধ্বনি তার শোনা যায়, পায়ের চিহ্ন ধরে বয়ে যাওয়া পথটার গায়, তার আসার রাতের কথা লেখা আছে বুঝি তায়। শ্রাবণ মেঘে এলো বুঝি নটবর। ঝিরি ঝিরি বর্ষণের ভেতর দিয়ে তার মুখ ভেসে ওঠে পাদপ্রদীপের আলোয়। বাইরে যখন রাজপথ জনপদজুড়ে উত্তাল ঝড়, নানামুখী ষড়যন্ত্রের ফলাফল অর্জনে লিপ্ত দুর্বৃত্তজনরা, অরাজকতার বিষবাষ্প ঢেলে দিতে সচেষ্ট সর্বত্র, নৈরাজ্যের আগুনে ঘি ঢালতে সক্রিয় দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীর ভেক ধরে, তখন তিনি ‘নৈশ বিহারে’ গেলেন অনিরাপদ অঞ্চলে। সমস্ত বিধিবিধান কিংবা প্রটোকল ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে বুঝিবা সন্তর্পণে পৌঁছে গেলেন কুমন্ত্রণাদাতাদের শিবিরে। পৌরাণিককালে রাধার অভিসার গমন নয় তা। কিংবা মুঘল যুগের মতো তাঁবু হতে তাঁবুতে পরিভ্রমণ নয়। এসেছেন তিনি ‘নৈশভোজে’। এভাবে যাওয়া তার নয় সঙ্গত। নিরাপত্তার চাদরহীন পরিবেশে এ রকম সন্তর্পণে হাজির হওয়ার ঘটনা বেমানান হলেও কোন রাখ-ঢাক তিনি করেননি। শক্তিধর দেশের দূত তিনি। রণবাদ্য শোনার আকাক্সক্ষা যদি থেকে থাকে তবে নিজ নিরাপদ অঞ্চলেই তিনি সম্মিলনের গানের শ্রোতা হতে পারতেন। নিজ ভুবনেই আয়োজন করা যেত জলসার। কিন্তু তাতে হয়ত থাকত না গোপনীয়তা। জানাজানির লাগাম টেনে ধরা যেত না। বুঝি তাই নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষকদের নিয়ে একান্তে চলে এলেন সেখানে, যেখানে অপেক্ষমাণ কূট-কৌশলের মন্ত্রণা জপতে থাকাদের মাঝে। তিনি শুনবেন, পরামর্শ দেবেনÑ এমন অবস্থানে নিজেকে সমর্পিত করে দিতে রাজ্যপাট উল্টে দিয়ে সটান বসে গেলেন আড্ডায়। আসর গুলজার করতে আগে থেকেই যারা অপেক্ষমাণ। তিনি এলেন, দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কাটালেন আলাপের মশগুলে। কিন্তু বিধি বাম! গোপন কথাটি আর গোপন থাকেনি। বেরসিক লোকজনের উৎপাতে সব ফাঁস হয়ে গেছে। হয়ত তিনি হয়েছেন বিব্রত। হয়ত নয়। উৎফুল্ল হওয়ার কারণও থাকতে পারে ভবিষ্যতের জন্য বিষকাঁটালি রোপণের সুবাদে। অন্ধ আবেগে নয়, সচেতনতার লতামূল ধরেই তিনি আপ্যায়িত হলেন ভোজসভায়। বাইরে তখন ঝড়ো হাওয়া, জনজীবনে অস্থিরতার অন্ধকার লুটোপুটি খাচ্ছে। এই অন্ধকারকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার কথাই হয়ত অভ্যাগতজনরা নানামুখী কথাবার্তায় মগ্ন হয়েছিলেন। রাজতখ্ত উল্টে দিয়ে দাবার ঘুঁটি চালার মোক্ষম সময়ে বুঝি তাদের কেটেছে রাতের শলাপরামর্শে। অন্দরমহলে যখন চলছে নানা দিক উন্মোচন, বাইরে তখন গুজবের তোড়ে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিস্তার ঘটছে। তাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য তারা যে যুযুধান হয়ে উঠবেন সেটাই স্বাভাবিক। এই যে নিশিরাতে চাঁদ গগনপারে আলোকিত হয়ে উঠেছিল, তখন পরবর্তী করণীয় বা গন্তব্য নিয়ে বেশ সখেদে মেতে উঠেছিলেন আলাপচারিতায়। মগ্ন এমনই হয়েছিলেন যে, রাত ফুরানোর আয়োজন তখন চলছে। বিতর্কিত সেই সব দ্বাদশ ব্যক্তির মাঝে মধ্যমণি হয়ে তিনি আসন পেয়ে উচ্চকিত প্রায়। রাত ৯টায় এসে যোগ দিলেন। ততক্ষণে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরীতে অনেক জল, অনেক ঢেউ প্রবাহিত হয়ে গেছে। শক্তিধর দেশের দূত তিনি। তাই অনায়াসে ভেঙ্গে ফেললেন প্রটোকল। তার এই ভোজসভায় অংশ নেয়ার বিষয়টিতে গোপনীয়তা ছিল বলেই জানলেন না নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ববানরা। এমনকি থানা-পুলিশও নয় অবহিত। তবে কি সবার চোখের আড়ালে থাকার উদগ্র বাসনায় তিনি যেভাবে এসে হাজির হলেন তাতে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বা বিধিবিধান লুপ্তপ্রায়। দূতের দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্ট গত তিন জুলাই যে নির্দেশনা দিয়েছিল তা উপেক্ষা কিংবা একপাশে ফেলে দিতে কোন কসুর করেননি। বাংলাদেশে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তাজনিত কারণে কতিপয় বিধিবিধান মেনে চলার জন্য বলা হয়েছে। নাগরিকরা চাইলেই যত্রতত্র খুশি ঘুরে বেড়াতে পারেন না। কোন মার্কিন কর্মকর্তা নির্ধারিত এলাকা ও নির্ধারিত সময়ের বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। নিরাপত্তাহীনতা ছিল, আছে, থাকতেও পারে। কিন্তু নির্ধারিত স্থানের বাইরে হুটহাট যাওয়া এক্কেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কোথাও চাইলেই যেতে পারবেনÑ এমন বিধান রাখা হয়নি। গুলশান, বারিধারা, বনানীর বাইরে রাতের বেলা গমনাগমন নিষিদ্ধের তালিকাভুক্ত। কিন্তু প্রয়োজন এত বেশি ছিল যে, নিষেধের পাহাড় ডিঙ্গাতেই হলো। তাই কোন ধরনের প্রটোকল ছাড়া কূটনৈতিক অঞ্চলের বাইরে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে সাড়া দিতে সটান চলে গেলেন এক এনজিও কর্মকর্তার বাসভবনে। নিজ দেশের বিধিনিষেধ একেবারেই শিথিল হয়ে গেল সে রাতে। আর যে বাড়িতে গেলেন সে বাড়ির মালিকানা নিয়ে ‘শালা-দুলাভাইয়ের’ রেষারেষি সর্বজনবিদিত। শ্যালক বাবাজীর দাবি, ভগ্নিপতি জোর করে তার বাড়ি দখল করে আছেন। দ্বন্দ্বটা পুরনো। কিন্তু নতুন করে প্রতিফলন ঘটল নিশিরাতে। যখন ভোজালোচনা চলছে তখন বাসভবনের নিচতলার বাসিন্দা শ্যালক ঘর হতে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রদূতের গাড়ির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বাদ সাধে দূতের সঙ্গে আসা প্রহরীরা। বাধা পেয়ে শ্যালক মহাশয় এমনই ক্ষিপ্ত হন যে, হট্টগোল বাধে। পাড়া-প্রতিবেশীর আগ্রহ প্রবল হলে চিৎকার করে বলতে থাকেন, এখানে সব সিআইএর এজেন্টরা আসর জমিয়েছে। এরা সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করছে। জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে তিনি উত্তেজনা তৈরি করতে কামিয়াব হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনা শেষতক জমে ওঠেনি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রও হয়ে পড়ে সঙ্কুচিত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দূত দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন শ্যালকের চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝেই। উপস্থিত মন্ত্রণাদাতা সুশীলরা যে যার মতো সটকে পড়েন। কিন্তু কতিপয় যুবক তার গাড়িকে লক্ষ্য করে পিছু ধাওয়া করে এবং ইট-পাটকেল ছোড়ে, যা অভব্য অবশ্যই। বিদেশী মেহমানের গাড়িতে এভাবে ঢিল ছোড়া গুরুতর অন্যায়। থানা-পুলিশকে খবর দিলে তারা ঘটনাস্থলে হাজির হয়। বিস্ময় প্রকাশ করে যে, একজন বিদেশী দূত তাদের এলাকায় এলেন, অথচ তারা কিছুই জানেন না। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে দায়ভার তাদেরই হতো। সুশাসনের জন্য নাগরিক নামক এনজিওর স্বত্বাধিকারী বদিউল আনম মজুমদারের বাড়িতে এমনভাবে আতিথ্য গ্রহণের নেপথ্যে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ ছিলেন যারা হাজির তারা নানাভাবে সমাজে বিতর্কিত। এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারকে গদি থেকে নামাতে সক্রিয় নানাভাবে। পালের গোদা হিসেবে প্রথমেই নাম আসে ডক্টর কামাল হোসেনের। সেখানে আরও ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, হাফিজ উদ্দিন খান, আসিফ নজরুল এবং দুটি পত্রিকার সম্পাদক। এরা সবাই আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। পরে হাজির হন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট। দেশে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরবর্তী শিবির-ছাত্রদল যখন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে, তখন সরকারবিরোধী এ গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক সন্দেহের দিগন্ত উন্মোচন করে বৈকি। বৈঠকের আলোচনা নিয়ে গুজবের নানা ডালপালাও ছড়িয়েছে। নিশিরাতে অশ্বারোহীরা সরাইখানায় যেত। এখনকার অশ্বারোহীরা ষড়যন্ত্রের পক্ষেই যাতায়াত করে। মোহাম্মদপুর থানায় সুজন কর্তৃপক্ষ মামলা করেছেন। ঘটনা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিও কূটনৈতিকসুলভ। কিন্তু অভ্যাগত সুশীল নামধারীরা বলেন, এটি স্রেফ দাওয়াতের অনুষ্ঠান। এক টেবিলে বসলে নানা আলোচনা হয়, আমরাও করেছি। এটা তো অন্যায় নয়। সঠিক কথাই বলেছেন, অন্যায় নয়। কিন্তু যারা নানা হিসাব-নিকাশ করেন রাজনীতির তাদের কাছে বিষয়টি এত সহজ-সরল নয়। এর মধ্যে সরকার পতন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে নৈরাজ্যÑ সবই খাদ্য হিসেবে মুখরোচক ছিল বলা যায়। সবই ঠিক আছে। কিন্তু কূটনৈতিক অঞ্চলের পুলিশ কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে এভাবে একজন দূতের অনিরাপদ অঞ্চলে ছুটে যাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। ফরিদপুরে জন্ম পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের বিখ্যাত গায়িকা গীতা দত্ত গেয়েছিলেন ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’ ঘটনার ঘনঘটায় সেই গানই উঠে আসে ঠোঁটে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×