ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বিএনপি কেন বারবার একই ভুল করে?

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৮ আগস্ট ২০১৮

বিএনপি কেন বারবার একই ভুল করে?

তেইশে জুলাই ঢাকায় গিয়েছি। ফিরে এসেছি চৌঠা আগস্ট। এবার দেশে একটি সুস্থ আন্দোলন দেখে এসেছি। সেটা স্কুল ছাত্রছাত্রীদের। বাস চাপায় দু’জন কিশোর শিক্ষার্থীর নির্মম মৃত্যু হওয়ায় এই আন্দোলন। এই আন্দোলন বহু আগে হওয়া উচিত ছিল। বাসচালক ও বাসের মালিকদের অত্যাচারে জনজীবন এখন জর্জরিত। যন্ত্রদানবের হাতে প্রত্যহ কারও না কারও মৃত্যুবরণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই মৃত্যু দুর্ঘটনার ফল নয়। এর অধিকাংশই ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা। একশ্রেণীর বাস মালিকের উদগ্র মুনাফার লোভে এসব ঘটনা ঘটছে। প্রায় অচল বাস রাস্তায় নামাতে, অদক্ষ ড্রাইভার নিয়োগে তাদের কোন দ্বিধা নেইা। তাদের কোন বিবেক-পীড়া নেই। মানুষের জীবনের চাইতে তাদের কাছে মুনাফার পাহাড়ের দাম অনেক বেশি। এদের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অসহনীয় ভাবে বাড়ছে। কোন সরকারের আমলেই এদের দাপট কমানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে এই বাস মালিক ও তাদের ড্রাইভারদের সাহস ও ঔদ্ধত্য আরও বেড়েছে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ মানুষও এখন এদের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের শিকার। এটা কোন স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়। এই ধরনের দুর্ঘটনা যারা ঘটায়, তারা ঘাতক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ঘাতকদের কোন শাস্তি হয় না। এরা মালিকদের প্রভাব ও ঘুষের জোরে দ- এড়িয়ে যায়। বছরের পর বছর আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থায় যে অরাজকতা চলছে, প্রত্যহ যন্ত্রদানবের শিকার হচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতা, এই প্রতীকারহীন অব্যবস্থার বিরুদ্ধেই শেষ পর্যস্ত রাস্তায় নামতে হয়েছে স্কুলের কচিকাঁচা ছাত্রছাত্রীদের। তারা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে আন্দোলন করতে হয়, যৌক্তিক দাবি তুলে ধরতে হয়। সরকারও তাই সঙ্গে সঙ্গে তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিয়েছে এবং বলেছে, তাদের দাবিগুলো সঠিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আন্দোলনের মোকাবেলায় দরদী অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছেন। কোন কঠোর পন্থা গ্রহণ করেননি। কিন্তু সরকার যাতে শিশু কিশোরদের এই আন্দোলনের মুখে কঠোর পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই অরাজনৈতিক আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের রাজনৈতিক সন্ত্রাসে পরিণত করা যায়, সেজন্যে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী শুরু থেকেই কম চেষ্টা করেনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে সকল প্রকার গাড়ির ফিটনেস, গাড়ির চালকদের দক্ষতা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা, তা পরীক্ষা করেছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের বয়স্ক ক্যাডাররা স্কুলছাত্র সেজে গাড়ি ভাংচুর করেছে, তাতে আগুন দিয়েছে। নিরাপদে সড়কের দাবিতে স্কুলছাত্রদের অহিংস আন্দোলনকে তারা হিংসাত্মক পথে টেনে নিয়ে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত করতে চেয়েছে। কিন্তু কচিকাঁচা স্কুল ছাত্রছাত্রীরা এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা না দেয়ার ব্যাপারে বয়স্কদের চাইতেও বুদ্ধি ও সচেতনতার প্রমাণ দিয়েছে। তাদের বড় অংশকে বিভ্রান্ত করতে না পেরে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কাডাররা নিজেরাই আওয়ামী লীগ অফিসে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নিজেদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যাপারে সরকার যে ‘কোমলতা’ দেখিয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে কোমলতা দেখাতে চায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ধৈর্য্যরে সীমা ছাড়িয়ে গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ধমকে কাজ হয়েছে। ছাত্রবেশী সন্ত্রাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসে পরিণত করে যারা সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে সারাদেশ অচল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। শিশু-কিশোররা ঘরে ফিরে গেছে। ঢাকা শহরে আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসেছে। বিএনপি-জামায়াত অতীতেও এ ধরনের ষড়যন্ত্র করেছে। তা সফল হয়নি। এবারেও হয়নি। বিএনপি অতীতের ভুল থেকে কোন শিক্ষাগ্রহণ করেনি। বিএনপির উচিত ছিল স্কুলছাত্রদের এই নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেয়া। অনৈতিক সন্ত্রাসের পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করা। তাতে আন্দোলনটির তারা ক্ষতি করেছে। দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার সত্যই অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। একশ্রেণীর পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি, বাস ও লরির অধিকাংশের প্রায় অচল অবস্থা, দক্ষতাহীন ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার নিয়োগ, অসাধু বাস মালিকদের সীমাহীন লোভের বাণিজ্য যে আজ জনগণের জীবনে অসহনীয় দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, সে কথা আগেই লিখেছি। দু’জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু ছিল একটি উপলক্ষ মাত্র, ছাত্রদের আন্দোলন যে এত স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন পেয়েছে, তার কারণ জনগণের মনে এত দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রোষ। সরকারের যেমন এটা বোঝা উচিত, তেমনি বিএনপিরও এই সত্যটা উপলব্ধি করে এই আন্দোলনে গঠনমূলক সমর্থন জানানো উচিত ছিল। তা না করে স্বভাবসুলভ অতীতের সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ ধরায় তারা আন্দোলনটির ক্ষতি করেছে এবং নিজেদের জনসমর্থনও বাড়াতে পারেনি। জনগণ তাদের আসল মতলবটি ধরে ফেলেছে। বিএনপিতে প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিকের সংখ্যা কম নয়। তবু তারা বারবার কেন একই ভুল করে, তা আমার বোধগম্য নয়। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে তাদের উচিত দেশের জনগণের দাবি দাওয়ায় সঙ্গে একাত্ম হয়ে এবং তা আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে নেমে দলের জনসমর্থনের ভিত্তি শক্ত করা এবং তাদের সমর্থনকে আন্দোলনের ভিত্তি করা। তা না করে তারা চায় সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের পথে রাতারাতি সরকার উচ্ছেদ। সেক্ষেত্রে সরকারও তাদের উপরে কঠোর দমননীতি চালানোর সুযোগ পায়। তাদের সন্ত্রাস দমনে সরকার প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করলে জনগণ তাতে ক্ষুব্ধ হয় না। বিএনপির প্রতি জনসমর্থন বাড়ে না। শাপলা চত্বরে সরকারের বিরুদ্ধে হেফাজতের বিশাল অভ্যুত্থান কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল না। ছিল একটি মৌলবাদী অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থান সফল হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হতো, এ কথা জেনেও বিএনপি এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে, এই অভ্যুত্থানের মাথায় পা রেখে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিল। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় আল্টিমেটাম দিয়েছিল। তাদের সেই চেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতা থেকে কোন শিক্ষা না নিয়ে এবারের নির্দোষ ছাত্র আন্দোলনকে বিপথগামী করার চেষ্টা দ্বারা তারা তাদের অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাল। এটা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের হঠকারী নীতি নয়, আত্মঘাতী নীতি। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের গাড়িতে এক বাইক আরোহী সম্প্রতি হামলা চালিয়েছিল। এটা অবশ্যই নিন্দনীয় ঘটনা। পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে এই বাইক আরোহীর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। আশা করা যায়, এই হামলার কারণ উদঘাটিত হবে এবং হামকারীরাও শাস্তি হবে। এই ধরনের ঘটনা নানা দেশেই ঘটে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশে কোন কোন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কথাবার্তায় একজন কূটনীতিকের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। বানির্কাটও বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক বিতর্কিত কথা বলেছেন। সে জন্য তার ওপর বাংলাদেশে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। তার বহিঃপ্রকাশ এই হামলা কিনা, তা আমি জানি না। তবু এই হামলা নিন্দনীয়। বিএনপি এই হামলার নিন্দা জানাতে পারত। কিন্তু স্বভাব যায় না মরলে; তাই এই হামলাকে তারা একজন রাষ্ট্রদূতের ওপর নয়, আমেরিকার ওপর আক্রমণ বলে প্রচার চালাচ্ছে। অর্থাৎ প্রচ্ছন্নভাবে বলতে চাইছে এই হামলার পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকার এবং তারা আমেরিকার ওপরেই এই আক্রমণ চালিয়েছে। এই প্রচারণা চালিয়ে তারা হয়ত আশা করছে, মার্কিন সরকার বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের ওপর রুষ্ট হবে এবং বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে মদদ দেবে। ধন্য আশা কুহকিনী। ট্রাম্প ও মোদি যুগের কূটনীতি বিএনপি এখনও আঁচ করতে পারেনি। বাংলাদেশে ’৭৫ সালের ন্যাশনাল ট্র্যাজেডির পর ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেনের জীবন নাশের চেষ্টা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে সুয়েজ যুদ্ধের পর ঢাকায় ব্রিটিশ তথ্য কেন্দ্র বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছিল, তাতে কেউ বলেনি এটা ভারত বা ব্রিটেনের ওপর আক্রমণ। এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলার মতো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণ না জানার আগেই বিএনপি ঘোষণা করেছে, এটা আমেরিকার ওপর আক্রমণ। বোকার সফল যে পোকায় খায় এটা তার প্রমাণ। এই কিছুদিন আগে বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার নেতাকর্মীরা লন্ডনে নিজ দেশের দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে, জাতির পিতার ছবি ভাংচুর করেছে। এটা কি তাহলে স্বদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা? আরও সহজ কথায়, স্বদেশ দ্রোহিতা? এই স্বদেশ দ্রোহিতার শাস্তি কি হওয়া উচিত, বিএনপি- নেতারা তা-কি জানেন না? বিএনপি নেতাদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, আগামী নির্বাচনে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হোন। অযথা ডন কুইক জোটের মতো বিফল যুদ্ধে শক্তিক্ষয় করবেন না। লন্ডন ৭ আগস্ট মঙ্গলবার, ২০১৮
×