ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের লড়াই আসন ধরে রাখার, বিএনপির পুনরুদ্ধারের

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৮ আগস্ট ২০১৮

আওয়ামী লীগের লড়াই আসন ধরে রাখার, বিএনপির পুনরুদ্ধারের

হাসান নাসির/বিকাশ চৌধুরী/জোবাইর চৌধুরী ॥ চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে উত্তর চট্টগ্রামের তুলনায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপির অবস্থান মোটামুটি সৃদৃঢ় ছিল। এখানে আসন সংখ্যা পাঁচটি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের পূর্বের প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ভাল করেছেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় প্রভাব ছিল বিএনপির এক সময়কার অন্যতম শীর্ষ নেতা কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীর বিক্রমের। তিনি বিএনপি ত্যাগ করার পর এই দলের প্রভাব খর্ব হতে শুরু করে। অবশ্য আওয়ামী লীগেও ছিলেন আখতারুজ্জামান বাবু এবং আতাউর রহমান কায়সারের মতো জাঁদরেল নেতা। তবে প্রয়াত এ দুই নেতার অনুসারীদের কোন্দলের কারণে আনোয়ারা আসনেও সঙ্কটে ছিল আওয়ামী লীগ। ধীরে ধীরে কোন্দল মিটিয়ে আওয়ামী লীগ সেখানে অবস্থান সুসংহত করতে শুরু করে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বর্তমানে প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের এমপি। সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে এবার আওয়ামী লীগে লড়াই হবে আসনগুলো ধরে রাখার। অপরদিকে, বিএনপির চেষ্টা থাকবে পুরনো প্রভাব প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনার। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রতিনিয়ত নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে। দলীয় কোন্দলই হতে পারে আওয়ামী লীগের কাঁটা। নির্বাচনের আগে এই কোন্দল নিরসন করা না গেলে এবার বেশ কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগকে মূল্য দিতে হতে পারে। সে তুলনায় দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল কম। বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে তৃণমূল থেকে শুরু কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ও বাঁশখালী সংসদীয় আসনের বর্তমান একাধিক এমপি নিজ দলের নেতাকর্মীদের কাছে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রতিটি সংসদীয় আসনে কম-বেশি রয়েছে দলীয় কোন্দল। একইভাবে বিএনপিতে বিরোধ প্রকাশ্যে না হলেও আছে বিভক্তি। ক্লিন ইমেজধারীদের মনোনয়নে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর বিএনপি হাইকমান্ড চাইবে যাদের মনোনয়ন দিলে ভোটে বিজয়ী হওয়া যাবে তাদের বেছে নিতে। কেননা, এই দলটির লক্ষ্য হারানো অতীত পুনরুদ্ধার করা। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ॥ চট্টগ্রামের পটিয়া একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলা। এলাকাটি সেই ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক লড়াইয়ের স্মৃতি বিজড়িত। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সামশুল হক চৌধুরী। সঙ্গত কারণেই তিনি মনোনয়নের প্রধান দাবিদার। পটিয়া আওয়ামী লীগে গ্রুপিং দীর্ঘদিনের। এই আসনে বর্তমান এমপি ছাড়াও এবার মনোনয়ন চাইবেন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির, সাবেক এমপি চেমন আরা তৈয়ব, পটিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদ ও যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউল আলম। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট হলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম মনোনয়ন চাইবেন। সিপিবির এই নেতা গণতান্ত্রিক বামজোট থেকেও প্রার্থী হতে পারেন। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বাড়ি পটিয়ায় হওয়ায় নানা কানাঘুষা চলছে। আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী ও গ্রুপিং থাকায় এবার শিল্পপতি মাসুদের ছোট ভাই আবদুস সামাদ লাভু সুবিধা পেতে পারেন। অপরদিকে, বিএনপি থেকে পটিয়ার সাবেক এমপি গাজী মোঃ শাহজাহান জুয়েল, উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী টিপু ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম ও ইদ্রিস মিঞা মনোনয়ন চাইবেন। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি ও আওয়ামী লীগের পটিয়ার সম্ভাব্য প্রার্থী মোহাম্মদ নাছির বলেন, পটিয়ার বর্তমান সংসদ সদস্য দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোন ধরনের মূল্যায়ন করেননি। যার কারণে তৃণমূলে ক্ষোভ রয়েছে। নৌকার প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে পটিয়াস্থ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি টিম দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। অপরদিকে পটিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, আগামী নির্বাচনে কোন ধরনের কারচুপি না হলে পটিয়া আসনটি পুনরায় বিএনপির। সাবেক এমপি গাজী মোঃ শাহজাহান জুয়েলকে পুনরায় প্রার্থী দেয়া হলে বিপুল ভোটে বিজয় সম্ভব। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সময়ে পটিয়ার রাস্তাঘাট উন্নয়নের নামে অর্থ হরিলুট হয়েছে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে এসবের জবাব দেবে। চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) ॥ বর্তমান সংসদ সদস্য ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বড় ছেলে। এই আসনে আওয়ামী লীগে গ্রুপিং না থাকলেও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ওয়াশিকা আয়েশা খান মনোনয়ন চাইতে পারেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে। তবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক এমপি সরোয়ার জামাল নিজাম ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য এ্যাডভোকেট কবির চৌধুরী। আনোয়ারায় একদা বিএনপির শক্ত ভিত্তি থাকলেও ক্রমেই সংহত হচ্ছে আওয়ামী লীগের অবস্থান। বিএনপির মাঠ পর্যায়ে বিভেদ থাকলেও কোন্দল ততটা প্রকাশ্য নয়। তবে মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক নেতা থাকলেও রাজনীতিতে বেশ ক’বছর তেমন সক্রিয়তা নেই। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) ॥ বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। এখানে সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও ব্যবসায়ী আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী মনোনয়ন চাইতে পারেন। বিএনপি নির্বাচনে এলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে, এই বিবেচনায় ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন চৌধুরী একজন শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারেন, এমনই ধারণা স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের। চন্দনাইশ আসনটি দীর্ঘদিন ধরে কর্নেল (অব) অলি আহমদের আসন হিসেবে পরিচিত। বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠনের পরও তিনি সেখান থেকে ছাতা প্রতীকে এমপি হয়েছিলেন। কর্নেল অলি দল ছাড়ার পর বিএনপিতে এখন রয়েছে নেতৃত্বশূন্যতা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন ডাঃ মহসিন জিল্লুর রহমান, চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ডাঃ শাহাদাত হোসেন ও এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মিজান। তবে ২০ দলীয় জোটগত নির্বাচন হলে চন্দনাইশে এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ বীরবিক্রমই প্রার্থী হবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) ॥ বর্তমান এমপি ড. আবু রেজা মোঃ নদভী। জামায়াত অধ্যুষিত এই আসনে এবার আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন চাইবেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বনফুল কোম্পানির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব সিআইপি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর অভিমত, ড. নদভী পাঁচবছর এমপি থাকলেও সাতকানিয়াতে তিনি দলের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। সে কারণে তারা কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম আমিনকে এবার প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। তবে জামায়াত অধ্যুষিত সাতকানিয়ার ভোটের রাজনীতিতে নদভী ভাল করতে পারেন এমন মতামতও রয়েছে। ২০ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচন হলে এ আসনটিতে জামায়াতে ইসলামীরই মনোনয়ন পাওয়ার কথা। কেননা আগেও এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন জামায়াতের মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী এবং আ ন ম শামসুল ইসলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ নেই। বিএনপি থেকে এ আসনে জোরালো প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক শেখ মোঃ মহিউদ্দিন। চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামী যে কয়েকটি আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারে তন্মধ্যে সাতকানিয়াও রয়েছে। সেক্ষেত্রে আ ন ম শামসুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) ॥ আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিজ নিজ দলে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপাতে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও স্বতন্ত্র হিসেবে লড়তে চান উপজেলা জামায়াতের আমীর। তবে নিবন্ধন না থাকায় তিনি কোন প্রতীকে কিভাবে লড়বেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে এবার মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির চৌধুরী লিটন, দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব ও অর্থ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সিআইপি। বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক পৌর মেয়র কামরুল ইসলাম হোছাইনী ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনের জন্য আলোচিত বিএনপি নেতা গ-ামারা ইউপি চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহামুদুল ইসলাম চৌধুরী ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাতীয় পার্টির সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ আবু বকর ছিদ্দিকী। এদিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে একাধিক প্রার্থী থাকলেও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন উপজেলা জামায়াত আমীর জহিরুল ইসলাম। বাঁশখালীকে টার্গেট করে জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করে আসছিল। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার পাশাপাশি বাঁশখালীতেও সড়ক অবরোধ, বেইলি ব্রিজ অপসারণ এবং বৃক্ষনিধনসহ নানা তৎপরতা চালিয়েছিল জামায়াত। দলীয় নিবন্ধন থাকলে হয়তো বা জামায়াতে ইসলামী এ আসনটি পাওয়ার জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করত। প্রতিকূল অবস্থায় শেষ পর্যন্ত জামায়াত থেকে কোন প্রার্থী থাকেন কিনা তা দেখার বিষয়।
×