ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোর কুমার দাশ ॥ ব্যতিক্রম এক তরুণের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৭ আগস্ট ২০১৮

কিশোর কুমার দাশ ॥ ব্যতিক্রম এক তরুণের গল্প

শিল্পী এসএম সুলতানের কাছে এক শিশুর জিজ্ঞাসা ছিল, ‘তুমি এত বড় বড় মানুষ আঁক কেন?’ ঠোঁটের কোণে স্মিতহাসি নিয়ে শিল্পী জবাবে বলেছিলেন, ‘কেন? মানুষ তো আসলেই অনেক বড়!’ তরুণ কিশোরের গল্পটা শুনে শিল্পীর ধারণায় আস্থা বাড়ে, মানুষ তো আসলেই অনেক বড়, সঙ্গে এটাও বলা যায় ইচ্ছা থাকলে সম্ভব। পেরু প্রবাসী এই তরুণের হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ। সেখানে বসেই কাজ করছেন দেশের মানুষের জন্য নিরলস। আসুন জেনে নেই খুব সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এক অসাধারণ তরুণ কিশোর কুমার দাশের গল্প। জানাচ্ছেনÑ পপি দেবী থাপা ডি প্রজন্ম : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা , শিক্ষা, পরিবার... কিশোর : আমি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। জন্ম চট্টগ্রামের কালুর ঘাটে, ১৯৮১ সালে। পিতা তৃতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী ছিলেন। মা গৃহিণী। আমরা ৫ ভাই-বোন। অভাবের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠা। অর্থাভাবে আমার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বাবা একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন। মায়ের চেষ্টা আর পরিশ্রমে আমরা ভাই-বোনেরা শিক্ষিত হয়েছি। আমাদের পরিবার বালাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিদ্বেষের প্রচ- ভুক্তভোগী। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আমরাই এ দেশে ছিলাম। আমি ১৯৯৭ সালে এ.এল.খান হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি এরপর এইচ.এস সি পাস করার পর চট্টগ্রাম প্রকৌশল এবং কারিগরি বিশ্ববিদালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে এমবিএ সম্পন্ন করি। আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে করপোরেট চাকরি করেছি। দেশে বিদেশে সবখানেই মোটামুটি একজন সফল কর্পোরেট অফিসার ছিলাম। ডি-প্রজন্ম : বর্তমানে পেরুতে কী করছেন? কিশোর : পেরুতেও কর্পোরেট চাকরি করেছি। তবে এখন ওখানে আমার একটি ছোটখাটো আবাসিক হোটেল আছে তার দেখাশোনা করি। এ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই আমার জীবনধারণ। ডি-প্রজন্ম : বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শুরু এবং কোন ভাবনা থেকে? কিশোর : বিদ্যানন্দের যাত্রা শুরু ২০১৩ সাল থেকে। প্রতিটি মানুষের যেমন একটি স্বপ্ন থাকে যে, সে দেশের জন একটা কিছু করবে। আমারও তেমনি সাধারণ একটা স্বপ্ন ছিল। দিনে দিনে যেমন স্বপ্নের বিস্তার হয়েছে একই সঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিসর বাড়ছে। ডি-প্রজন্ম : নাম বিদ্যানন্দ হওয়ার পিছনের কারণ... কিশোর : আমার ইচ্ছা ছিল একটি স্কুল গড়ে তোলার। যেখানে ছেলেমেয়েরা শুধুই যে পড়ালেখা করবে তা নয় তারা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষালাভ করবে। আমার এই আইডিয়াটিকে আমি এশিয়াটিক সোসাইটির ক্রিয়েটিভ ডাইরেক্টর মিরাজুল হক ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করি। তিনিই বিদ্যানন্দ নামটি উপস্থাপন করেন এবং এর লোগোও তিনি তৈরি করেন। ডি-প্রজন্ম : কতটি শাখা আছে এবং কোথায়? কিশোর : শাখা ৮টি। এগুলো হচ্ছে : ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী। এর মধ্যে ৫টি জেলায় ফাউন্ডেশনের নিজস্ব জমি রয়েছে। ডি-প্রজন্ম : জমি ক্রয়ের উৎস... কিশোর : আমাদের জমির পরিমাণ ৭০-৮০ বিঘা। এর মধ্যে ১০ বিঘা ফাউন্ডেশনের অর্থে কেনা। বাকি সবটাই দানে পাওয়া। ডি-প্রজন্ম : কতজন স্বেচ্ছাসেবক কর্মরত রয়েছেন? কিশোর : সাড়ে তিনশ’র অধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। যারা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তবে যারা মাঠে কাজ করছেন কেবল তাদের একটা বেতন ধরা হয়। যা গড়ে ৪০০০-১০০০০ এর মধ্যে। কেননা তারা অন্যত্র কাজ ছেড়ে আমাদের এখানে আসেন। তাদের কাজের কাছে এটা সামান্য কিছু। তবে তারা সকলেই আনন্দের সঙ্গে কাজ করেন। ডি-প্রজন্ম : ফাউন্ডেশনের এত কার্যক্রম, এ কয়জন মিলে কিভাবে সম্পন্ন করেন? কিশোর : মানুষের রয়েছে অফুরন্ত কাজ করার ক্ষমতা। সে চাইলে অনেক কাজ করতে পারে। এর জন্য দরকার ইচ্ছাশক্তির। যদি সেটা সে তার মধ্যে জাগাতে পারে তাহলে সম্ভব। অন্যদিকে বেশি মানুষ থাকলে একেক জনের একেক ধরনের সমস্যা থাকে, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকে। যে গুলো দ্রুত কার্যসম্পাদনে বাঁধার সৃষ্টি করে। ডি-প্রজন্ম : বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এ পর্যন্ত করা কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজগুলো কী কী? কিশোর : এক টাকায় খাবার বিতরণ। এ পর্যন্ত একুশ লাখ ব্যক্তিকে আমরা খাবার বিতরণ করেছি। সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য স্কুল। ৮টি স্কুলে শিক্ষার্থী রয়েছে ১৫০০ জন। এক টাকায় চিকিৎসা। এ পর্যন্ত সেবা পেয়েছে ১১০০০ রোগী। বিদ্যানন্দের রয়েছে নিজস্ব প্রকাশনা যেখান থেকে প্রতিবছর ডজনখানেক বই বেড় হয়। এক গ্লাস দুধ কর্মসূচী। এটি বস্তির গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টি নিশ্চিতের একটি প্রকল্প। রোজার সময় আমরা বড় আকারে ইফতারের আয়োজন করে থাকি। এ বছরের সবচেয়ে বড় ইফতার আয়োজন আমরা করি। সোয়া দুই লাখ মানুষকে ইফতার বিতরণ করেছি। এটা অর্গানাইজ করার জন্য প্রত্যেক বছর রোজার সময় দেশে আসি। ২০১৫ সালে ‘ফ্রেমে বাঁধা শৈশব’ নামে আমরা একটি কাজ করি। যেখানে সারা বালাদেশে ১০০০০ হাজার ছিন্নমূল শিশুর ছবি তুলে তাদের হাতে দেওয়া হয়। আমার শৈশবের কোন ছবি নেই। তাই এ বিষয়ে আমার অনুভূতি থেকেই একাজের উৎপত্তি। ২০১৭ সালে আমরা ১২১টি গরু ও ছাগল কোরবানী দেই এবং মাংশ উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলে দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করি। ডি-প্রজন্ম : খাবারের মূল্য ১ টাকা নির্ধারণের কারণ? কিশোর : এক সময় আমিও খাদ্যাভাবে ছিলাম। খাবারের জন্য যেখানে গিয়েছি সেখানে দুই রকম মানুষ দেখেছি, দাতা এবং গ্রহীতা। তখন আমি দানের বিষয়টা গ্রহণ করতে পারতাম না। এই ভাবনা থেকেই খাবারের মূল্য নির্ধারণ করি ১ টাকা। এতে দানের বিষয়টি নিয়ে দাতার মনে অহঙ্কার সৃষ্টি হবে না গ্রহীতাও হীনমন্যতায় ভূগবে না। ডি-প্রজন্ম : ফাউন্ডেশনের অর্থের যোগান আসে কিভাবে? কিশোর : প্রথম দেড় বছর আমি আমার নিজের টাকাতেই এ ফাউন্ডেশনের হাল ধরে রাখি। এখন বাজেট এত বেশি হয়ে গেছে যে, চাইলেও একা আর পারব না। তবে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে দেই। ফাউন্ডেশনের সমস্ত বিষয়ই আমরা অনলাইনে প্রকাশ করি। সব কাজই আমরা খোলামেলাভাবে করি। আমাদের ডোনারদের কাছে ফাউন্ডেশনের সকল বিষয়ই স্বচ্ছ থাকে। কেউ প্রথম বারেই হুট করে টাকা দেয় না। প্রথমে ৫০০০ দিলে পরের বার হয়তো ৫০০০০ দেয়। যে আমাদের ৫০০ টাকা দেয় সে নিজেই দেখতে পায় তার টাকাটা কোন খাতে কীভাবে খরচ হচ্ছে। ফলে তার ভিতর আস্থার সঞ্চার হয়। যারা ফাউন্ডেশনে টাকা পাঠান তারা কেউ আমাদের পরিচিত নন। তারা প্রথমে ফেসবুক পেইজ দেখেন। পছন্দ হলে লোক পাঠান অথবা নিজেরা এসে সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষভাবে দেখেন। তারপর তারা ডোনেট করেন। ডি-প্রজন্ম : প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়? কিশোর : আমাদের প্রত্যেকটি কার্যক্রম সিসটেমেটিক ওয়েতে পরিচালিত হয়। আমাদের প্রত্যেকটি বিষয় দেখার জন্য আলাদা আলাদা গ্রুপ রয়েছে। যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন, আইটি, অডিট বিভাগ ইত্যাদি। আমরা বাংলাদেশে একটি মাত্র ফাউন্ডেশন যারা আমাদের কাজের অডিট করাই। সেই রিপোর্ট অন-লাইনে প্রচার করি। যিনি অডিট করেন তিনি আমাদের টপ ডোনারের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই ফাউন্ডেশনে আমরা যারা আছি আমরা কেউই কখনই মনে করি না যে এটা আমার। আমি এর চেয়ারম্যান হলেও এটা আমার একার এভাবে ভাবি না, তেমনি অন্য সকলেরই। ডি-প্রজন্ম : পেরুতে থেকে এ সকল কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা করেন? কিশোর : আমি মনে করি দূরে থেকেই সমস্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। আমাদের সমস্ত কাজই অনলাইনভিত্তিক। সবখানেই সি.সি ক্যামেরা রয়েছে। আমি এখান থেকেই প্রতিটি কাজ দেখতে পাই। প্রত্যেকটি কাজের আপডেট জানতে পারি। দেশে থাকলে মিষ্টভাষী মানুষেরা সব সময় আমাকে ঘিরে থাকবে। এ বলবে অপনি অসাধারণ, ও বলবে আপনার মতো লোক হয় না ইত্যাদি কথাবর্তা। সর্বোপরি আমি একজন মানুষ, আমার মধ্যে লোভ আছে, ভোগের ইচ্ছা আছে এসব কথা যখন আমি প্রতিনিয়ত শুনতে থাকব এক সময় হয়তো আমার মধ্যেও দাম্ভিকতা জন্ম নিতে পারে। সুবিধা হচ্ছে, এ কথাগুলো এত দূরে আমার কাছে আসতে পারবে না। আর এসবে কাজের ক্ষেত্রে সময় অপচয় হয়। ডি-প্রজন্ম : সামনে নতুন পরিকল্পনা... কিশোর : আমরা আসলে কোন পরিকল্পনা করে এগোই না। আমরা নিজেরাই জানি না কাল আমরা কী করতে যাচ্ছি। আমি আমার ভলেনটিয়ারদের এভাবে ইনস্পেয়ার করি ‘‘উড়দহঃ ঃযরহশ ঃড়ড় সঁপয, লঁংঃ ফড় ংড়সবঃযরহম.” যেমন একটা লোক হাঁটছে, তার কোন গন্তব্য নেই। এই গন্তব্যবিহীন হাঁটাটাই তার গন্তব্য। গত মাসে হঠাৎ করেই আমরা একটা গার্মেন্টস নিয়েছি। এখন প্ল্যান করছি ওটা থেকে কি করা যায়। এবং এর থেকে উৎপন্ন পণ্য দিয়ে কীভাবে আমরা মানুষের প্রয়োজনে আসতে পারি। আমরা যা করি তা দিয়ে বাংলাদেশের কিছুই করতে পারব না। তবুও আমরা করি কারণ আমরা কিছু প্রেরণার গল্প তৈরি করতে চেয়েছি যা দেখে বাংলার আর দশটি মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের মতো করে কাজ করবে। আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনায় আমরা অনুপ্রেরণার নতুন নতুন গল্প তৈরি করব নতুন রূপে নতুন সাজে। ডি-প্রজন্ম : নতুন গল্পের মধ্যে আপনার স্বপ্নের গল্পটি... কিশোর : আমরা পাহাড়ী এলাকায় দুটি বড় গ্রাম বানাচ্ছি। যেখানে আদিবাসী, এতিম ছেলেমেয়েরা থাকবে। আমার ইচ্ছা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অনেক বড় জায়গার ওপর একটি গ্রাম থাকবে। যেখানে ওল্ড হোম, চাইল্ড হোমসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সেখানে মানুষ আসবে অনুপ্রাণিত হতে। সোস্যাল ওয়ার্ক কীভাবে করতে হয় সে বিষয়ে ধারণা নিতে। যা দেখার জন্য মানুষ আসবে বিভিন্ন দেশ থেকে। তারা সেখানে তিন মাস, ছয় মাস স্টাডি করবে। ফিরে গিয়ে নিজেদের মতো করে কাজ করবে। ডি-প্রজন্ম : আপনার জীবন দর্শন... কিশোর : আমি জীবনে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলাম। আমার এখনকার জীবনাচারও সন্ন্যাসীর মতই। তবে আমার নীতি হচ্ছে ‘‘মানুষ ধর্ম মানে রীতিতে, আমি ধর্ম মানি নীতিতে।’’ ডি-প্রজন্ম : কেমন বালাদেশের স্বপ্ন দেখেন? কিশোর : যে বাংলাদেশের মানুষের মনে থাকবে একে অপরের প্রতি ভালবাসা। হানাহানি, বিদ্বেষ ভুলে মানুষ হবে সহনশীল, উদার। আমাদের কাতার কিংবা সৌদির মতো ধনী হতে হবে তা নয় আমরা মনুষ্যত্বের জয়গান গাইব। আমাদের মধ্যে জাত, শ্রেণী, ধনী গরিবের ভেদাভেদ থাকবে না। আমরা যাই করব একত্রে মিলেমিশে করব। বাংলার মানুষ গর্ব করে বলবে ‘আমরা বাংলার মানুষ সবার সেরা।’
×