ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা প্রমাণ মিলেছে

জামায়াত-বিএনপির ছকে ঢাকা অচলের ষড়যন্ত্র হয়েছিল

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ আগস্ট ২০১৮

জামায়াত-বিএনপির ছকে ঢাকা অচলের ষড়যন্ত্র হয়েছিল

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াতের ছকে কষা ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সঙ্গে নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে হুবহু মিল খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। কোটা আন্দোলনের মতোই নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যা, মৃত্যু, রগকাটা, ছাত্রী ধর্ষণ, লাঞ্ছিত করার মিথ্যা, বানোয়াট, ভুয়া গুজব ছড়িয়ে ছাত্রদের উত্তেজিত ও ক্ষেপিয়ে তুলে সহিংস করে তোলার জন্য উস্কানি ও মদদ দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। কোটা আন্দোলনের সময়ে টার্গেট করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে টার্গেট করা হয় ধানম-িতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়। কোটা আন্দোলনকে আরও সংগঠিত (অর্গানাইজড) করতে টেলিফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মামুনকে নির্দেশ দেন লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী টেলিফোনে কুমিল্লায় অবস্থানরত নাওমি নামে এক বিএনপি কর্মীকে বলছেন, ঢাকা এসে লোকজন নিয়ে নেমে পড়তে। তারেক রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দুই জনের ফোন আলাপের অডিও ক্লিপ সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যার তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঢাকা শহর অচল করে দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে ষড়যন্ত্র করতে প্রথমে কোটা আন্দোলন ও পরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। বিএনপি-জামায়াতের ছকে কষা কোটা আন্দোলন যেভাবে শক্ত হাতে মোকাবেলা করা হয়েছে সেভাবেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের উস্কানি মদদদানের বিরুদ্ধে হার্ড লাইনে গেছে সরকার। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে, ছাত্রদের চলমান আন্দোলনের মাত্র ৪ মাস আগে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে গড়ে ওঠা কোটা আন্দোলন, যা পরে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে বিএনপির নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সেই রাতে ভিসির বাসভবনে হামলার জন্য ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির নিজেরা তো ছিল মুখোশ পরা। এছাড়া ভাড়াটিয়া পেশাদার সন্ত্রাসীদের এনেছিল এই দুটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এসব ঘটনার কোন কিছুই আঁচ করতে পারেনি কোটা আন্দোলনরত মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। তাদের আন্দোলনকে বেগবান করতে লন্ডনে বসে ষড়যন্ত্র করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান। কোটা আন্দোলনকে আরও অর্গানাইজড করতে টেলিফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে নির্দেশ দেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মামুনকে। অধ্যাপক মামুন নিজেও তারেক রহমানের সঙ্গে কথোপকথনের কথার অডিও টেপটি পরীক্ষা করে সত্যতা পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। কোট সংস্কার আন্দোলনের সময় মৃত্যু ও রগ কাটার মতো উস্কানিমূলক মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) প্রচার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যারা সহিংস করে তুলেছে তাদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। পুলিশের সাইবাবর ক্রাইম ইউনিট সে সময় দুই শ’র মতো এ্যাকাউন্টকে সন্দেহ করে তা শর্টলিস্টে এনে প্রায় এখন দাঁড়িয়েছে ত্রিশটি এ্যাকাউন্টে। এখন এই এ্যাকাউন্টগুলো পর্যালোচনা করে উস্কানিমূলক তথ্য প্রচার ও গুজব রটনাকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক পেজ, ফেসবুক ও টুইটারে ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট এবং কিছু অনলাইন পোর্টাল। ছাত্রী মোর্শেদার রগ কাটার অভিযোগে এশা নামের ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তার শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। কারণ ছাত্রী এশার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়েছিল। ঠিক অনুরূপভাবে আন্দোলনের সময়ে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে যে গুজব ছড়ানো হয় তাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে এক ছাত্রীকে মারধর ও তার পায়ের রগ কেটে দেয়ার অভিযোগ ওঠে মহিলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফত জাহান এশার বিরুদ্ধে। এরপর ওই রাতে হঠাৎ করে ফেসবুকে একটি রক্তাক্ত পায়ের ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়। বাস্তবে ফেসবুকের এসব তথ্যের কোন মিল পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকটি ফেসবুক আইডি, পেজ ও গ্রুপ, ইউটিউব, টুইটার, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ, ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্রদের আন্দোলনেও গোয়েন্দা তদন্তে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনে যেভাবে ভিসির বাসভবনে সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানো হয়েছে, ঠিক অনুরূপভাবেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়কে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে শনিবার ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে হামলা চালানোর সময়ে শিক্ষার্থীদের নাম করে বেশ কিছু বহিরাগতও অংশ নিয়েছিল এই হামলায়। শনিবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয় আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েকজনকে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি ধর্ষণ ও মৃত্যুর গুজবও ছড়ানো হয়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের পার্টি অফিসে নিয়ে যান। সেখানে পুরো অফিস তাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়। পরে তারা সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, আসলে সেখানে কিছুই হয়নি। গুজব ছড়িয়ে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাহলে পরের দিন রবিবারও কেন মিছিল নিয়ে ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের দিকে যেতে হলো? রাজধানীতে মিছিল বা সমাবেশ করার অনেক স্থান থাকার পরও কেন ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যায়লকে টার্গেট করা হলো সেটাই এখন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তদন্তের সামনে প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, যখন ধানম-িতে শিক্ষার্থীদের আড়ালে একদল দুর্বৃত্ত আচমকা হামলা চালানোর সময়টিকেই বেছে নেন অভিনেত্রী নওশাবা আহমেদ। ঢাকা এ্যাটাক চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রী ফেসবুক লাইভে হাজির হন। তিনি ফেসবুক লাইভে হাঙ্গামায় চার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং চার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে খবর জানায়। আর হামলার কারণে যারা আটকা পড়ে আছে তাদের উদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানান। এমনকি নিহতদের লাশ আওয়ামী অফিসে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। এ খবর বিদ্যুতগতিতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে দেয়। অফিসের বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালায়। শেষ পর্যন্ত কিছুই না পেয়ে আন্দোলনকারীরা হতাশ হলেও যা সর্বনাশ ঘটানোর দরকার ছিল তখন তা ঘটানো হয়ে গেছে। নওশাবাকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আন্দোলনকে দিনের পর দিন টিকিয়ে রাখারও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল নওশাবার। আন্দোলনকারীদের উস্কে দিতে তিনি সরকার দলীয় লোক ও পুলিশের হামলায় চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও ছাত্রী ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অভিনেত্রী নওশাবার মতো আরও অন্তত ২৯টি ফেসবুক আইডি পেয়েছে যাদের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে। এসব ফেসবুক আইডির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে হামলা মধ্যেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত ৪ আগাস্ট একটি অডিও ক্লিপ সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যাতে শোনা যায়, কুমিল্লায় অবস্থানরত নাওমি নামে এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। নাওমিকে তিনি বলছেন, ঢাকা এসে লোকজন নিয়ে নেমে পড়তে। সারাদেশে বিক্ষোভের মধ্যে শনিবার একটি অডিও রেকর্ড ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সেই ফোনালাপে আন্দোলনে মানুষ নামানোর কথা বলা হয়। পুলিশ নওমিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। বিএনপির এই নেতা ছাড়াও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর হুকুমে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছাত্রদলের লোকজন ঢুকে পরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যেমন, জিগাতলায় ছাত্রদলের কর্মীরা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা ও বিভিন্ন জায়গায় পরিবহনে অগ্নিসংযোগ এবং ছাত্রী ধর্ষণ ও ছাত্রছাত্রীদের নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার করার চেষ্টা করে বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানোর জন্যই কোটা আন্দোলনের মতো নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ছিনতাই করে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত এবং দুটি ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তুলে সহিংসতায় উস্কানি দেয়ার ঘটনায় হুবহু মিল পাওয়া গেছে। এই দুইটি আন্দোলনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন থাকার তথ্য প্রমাণও পাওয়া গেছে।
×