ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৬ আগস্ট ২০১৮

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমৃদ্ধ যুগে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার যে আধুনিক নব্যধারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা যেমন তাঁর নিজের জন্য সুখকর হয়নি একইভাবে সর্বসাধারণের কল্যাণে এই ইউরোপীয় বিদ্যার্জনকে মোটেও সমর্থন করতে পারেননি। ‘জীবন স্মৃতি’তে আছে কিভাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের শুভ সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে তা কোন্ অবস্থায় পৌঁছায়। ততদিনে মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা কর্মসূচীতে অবিভক্ত ভারতের নব্য শিক্ষিত শ্রেণীর বিকাশ লাভ করতে থাকে। যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়Ñ আমরা এমন এক শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলব যারা রক্তে-মাংসে ভারতীয় থাকলেও চিন্তা-চেতনায়, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিতেও হবে পুরোপুরি ইংরেজ। মেকলে প্রবর্তিত এই শিক্ষানীতি ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণীকে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা হয় ইংরেজরা এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় গড়ে তুলল যারা ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকে কিছুটা হলেও মজবুত করেছিল। কবির ‘জীবন স্মৃতি’র ‘শিক্ষারম্ভ’ অধ্যায়টিতে বিধৃত আছে : প্রথমবার স্কুলে যেতে না পারার মর্মবেদনা। ‘তাহার পর যে কথাটি মনে পড়িতেছে তাহা ইস্কুলে যাওয়ার সূচনা। একদিন দেখিলাম দাদা এবং আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনের সত্য স্কুলে গেলেন, কিন্তু আমি ইস্কুলে যাইবার যোগ্য বলিয়া গণ্য হইলাম না। উচ্চৈঃস্বরে কান্না ছাড়া যোগ্যতা প্রচার করার আর কোন উপায় আমার হাতে ছিল না।’ পরিবারের গৃহশিক্ষক একটি যথার্থ বাস্তবসম্মত উপদেশ বার্তা শুনিয়েছিলেন। এখন স্কুলে যাবার জন্য যে কান্না এবং আকাক্সক্ষা একদিন তার চেয়ে বেশি অনীহা প্রকাশ পাবে স্কুলে যাতে যেতে না হয় সে তাড়নায়। এত বড় অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী কবি জীবনে আর কখনও শোনেননি। এক সময় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। কবি স্কুলে যাবার সুখস্বপ্নের সঙ্গে সত্যিই জড়িয়ে পড়লেন। কবির মতে, একেবারে অকালেই ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হলেন। প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষা হাতের কাছে আসতে না আসতেই স্বপ্নভঙ্গের হতাশাও ভিড় জমাতে থাকে। স্কুলের শিক্ষালাভ তো মনেই থাকল না, সমস্ত স্মৃতিজুড়ে দুঃসহ শাস্তির মর্মবেদনা জীবনভর তাড়া করল। সকাল ১০টা-৪টা স্কুলে যাওয়াটা কবির কাছে ছিল ৬ ঘণ্টা আন্দামান দ্বীপের নির্বাসিত জীবন। সেই কারণে সৃজনশীলতার পাশাপাশি সচেতন মননেও পড়ে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ফলে শিক্ষা ভাবনা তার চেতনার অনুষঙ্গ হয়ে থাকত সব সময়ই। যেখানে প্রাচীনকালের শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক সময়ের ইউরোপীয় বিদ্যাচর্চা এমনকি বিশ্বপরিসরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সব মিলিয়ে শিশুদের মানসিক আনন্দের প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পৃক্ত করা। শিক্ষা যেন মুখস্থ করা চাপানো কোন বিজাতীয় বিষয় না হয়। আর তাই সর্বসাধারণে উপযোগী শিক্ষা যা শুধু জ্ঞানের পরিধি কিংবা মানসিক বিকাশকেই সমৃদ্ধ করবে না, সঙ্গে প্রতিদিনের কর্ম এবং জীবন প্রবাহেও আবশ্যকীয় উপাদান জোগাবে। মুখস্থ করা বিদ্যাচর্চা কখনই নিজেকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক ধারায় গড়ে উঠতে দেয় না। শিক্ষা হবে সর্বজনীন এবং তা সব মানুষের মৌলিক অধিকারও। যেখানে সবার আগে বিবেচনায় থাকবে মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি। বিজাতীয় ভাষা কিংবা ভিনদেশী পরিবেশ যথার্থ শিক্ষার অনুবর্তী হতে পারে না। তিনি মনে করতেন দেশীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সময়ের পালাক্রম যেমন অবিমিশ্র থাকবে পাশাপাশি বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনাও শিক্ষাব্যবস্থার আবশ্যিক পূর্ব শর্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যা শুরু করতে হবে অতি বাল্যকাল থেকে। কোমলমতি শিশুদের আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে বিদ্যায়োজনের ভিত্তি প্রস্তুত করতে না পারলে শিক্ষা হবে অসম্পূর্ণ, খ-িত এবং আংশিক। আর মাতৃভাষা হবে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল শেকড় যার সমৃদ্ধ বাতাবরণে শিশু-কিশোররা নিজের ভবিষ্যতকে শুধু আপন ভাগ্যোন্নয়নেই নয়, দেশের ভাবী কর্ণধার হিসেবেও গড়ে তুলতে পারে। মনোজগতের স্বাধীনতা শিশুদের চিত্ত উৎকর্ষের অন্যতম নিয়ামক। ফলে চিত্তাকর্ষের জন্য যেমন উন্মুক্ত মনোজগত চাই একইভাবে তাকে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক স্বাধীন জ্ঞানচর্চার পরিশুদ্ধ উপকরণও আবশ্যক। অর্থাৎ জাতীয় বিজাতীয় ভাষা কিংবা সংস্কৃতি বাদ দিয়েও বলা যায় জ্ঞান সরোবরে অবগাহনের জন্য অবারিত, মুক্ত একটা সর্বজনীন প্রতিবেশ বিশেষ জরুরী। কবির ভাষায় বলা যায়, ‘স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভাল করিয়া মানুষ হইতে পারে না- বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায় (শিক্ষার হেরফের)।’ তবে কবির আশঙ্কা আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের জন্য অতখানি সময় ব্যয় করতে চিন্তিত হয়ে পড়ি। রুদ্ধশ্বাসে, দ্রুততার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক হজম করতে পারুক কিংবা না পারুক সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে মুখস্থ করাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার এই ব্যস্ততম পর্বে ইউরোপীয় শিক্ষার তীব্রতর সম্মিলনে জ্ঞানচর্চার চাইতেও বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে ইংরেজী ভাষা গলাধঃকরণে। যাতে অবোধ বালক-বালিকারা কিছুমাত্র মানসিক বিকাশ ছাড়া জড় পদার্থের ন্যায় মুখস্থনির্ভর হয়ে বিদ্যা নামক অতি আবশ্যক বিষয়টি হজম করবার অবস্থায় পৌঁছতে পারে না। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ যোগ ব্যাহত হলে শিক্ষালাভ যথার্থ হয় না। শুধু তাই নয়, অন্তর্নিহিত বোধও এর বিপরীতে চলে যায়। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবই কণ্ঠস্থ করতে হয়, যা আত্মস্থ করার পর্যায়ে থাকে না। ফলে মেধা এবং মনন বিকাশে তৈরি হয় পর্বতপ্রমাণ বাধা। তাই আবশ্যকীয় পাঠ্যপুস্তক যেমন বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট গন্ডির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নিত্যনতুন আনন্দযোগ যদি তাকে যথার্থ সঙ্গ দিতে না পারে তাহলে সত্যিকারের শিক্ষা তার ঐতিহ্যিক গতি হারাতে পারে। অবিমিশ্র মিলনের স্রোতধারায় প্রয়োজনীয় আরও সুখপাঠ্য গ্রন্থের অবতারণা করা যেতে পারে যেখানে মনোজগত আর মেধার স্ফুরণে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা জীবন শুধু জ্ঞানার্জনই নয় পরিপূর্ণ মানুষ হবার ক্ষেত্রকেও উন্মুক্ত আর অবারিত করবে। সর্বভারতীয় ঐতিহ্যিক ধারাই শুধু নয়, আধুনিকতার সমৃদ্ধ পরিবেশে মাতৃভাষা চর্চার বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। কবির ভাষায় শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। যার অভাবে শিক্ষা পরিপুষ্টি লাভ করে না, সর্বাঙ্গীন হয় না, তার চেয়েও বেশি প্রতিদিনের জীবন ও কর্মপ্রবাহে এই অর্জিত বিদ্যা কোন সুফল বয়ে আনে না। শুধু পাঠ্যপুস্তকই নয় যারা এই মহৎ পেশার সঙ্গে জড়িত সেই শিক্ষকমন্ডলীরও আবশ্যিক জ্ঞানার্জনের একটি বিশুদ্ধ এবং বিস্তৃত পরিধি থাকা সঙ্গত। কারণ এই সম্মানিত শিক্ষকরাই প্রাথমিকভাবে মাতৃ এবং ভিনদেশী ভাষার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলন ঘটান। ভাল বাংলা এবং ইংরেজীতে পারদর্শী হতে না পারলে শিশুদের শিখানোর চাইতেও ভুলানো বেশি সহজ হয়ে যায়। কবির মতে মাতৃভাষার প্রতি নিবেদিত হয়ে বিদ্যালয়ের আবশ্যকীয় গ্রন্থই শুধু নয়, দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বইও বিদ্যাচর্চার অন্যতম নির্ণায়ক হওয়া জরুরী। কারণ ভাষা শিক্ষার সঙ্গে চৈতন্যের উৎকর্ষ অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার যদি নিয়মিত হয় তাহলে শিক্ষা তার যথার্থ মর্যাদায় আসীন হতে পারে। ঐতিহ্য আর জীবন-বিচ্ছিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা কোন দেশ কিংবা জাতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে না। শিক্ষা কেবল ব্যক্তিকে উপলব্ধি কিংবা সমৃদ্ধির নিয়ামক হয় না যদি তার সঙ্গে সমাজ-সংস্কার-দেশাত্মবোধ একীভূত হতে না পারে। নিজস্ব বৈভবের সমৃদ্ধ আঙিনায় সদর্প বিচরণ সমস্ত বিভ্রান্তি আর বিপত্তির অবসান ঘটাবে। যেখানে প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ এবং আধুনিক সময়ের আবর্তে সমস্ত মানসিক আর মানবিক সম্পদে পরিপূর্ণ আবহমান বাংলাকে শিক্ষাব্যবস্থার সহযোগী করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্বপরিসরের নব নব উদ্ভাবন আর বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রাকে শিক্ষা কার্যক্রমের অবিচ্ছিন্ন করতে না পারলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অভিগমন ব্যর্থ হবে। প্রসঙ্গত কবি উল্লেখ করেন ‘ভারতী’ আর ‘বঙ্গদর্শনে’র মতো নিয়মিত প্রচার মাধ্যম আমাদের সচেতন জগতকে উৎকর্ষতার দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। ‘প্রবাসী’ এবং ‘সবুজপত্রে’র মতো সময়ের প্রকাশ মাধ্যমকেও কবি জ্ঞানার্জনের অন্যতম আধার হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমাদের নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাও অব্যাহত রাখতে হবে। অতি পুরাকাল থেকে আজ অবধি চিরায়ত বাংলার সমস্ত মঙ্গল যোগ জীবনের সঙ্গে, কর্মের পরিধিতে এবং শিক্ষা কার্যক্রমে মিলাতে হবে, তবেই না আমরা মানুষ আর বাঙালী হিসেবে মাথা উঁচু করে নিজের পরিচয় দিতে পারব। আর তাই প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহের আবশ্যিকতায় শিক্ষার যদি গভীরতম সংযোগ তৈরি না হয় তাহলে এই বিদ্যার্জনের সুফল আমরা পাব না। নিজের আদর্শিক চেতনা এবং উপলব্ধি থেকে শান্তিনিকেতনে জ্ঞানের যে দ্বার তিনি অবারিত করলেন সেখানে সিংহভাগজুড়ে থাকল দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, মাতৃভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান, জীবন-ঘনিষ্ঠ পাঠ্যক্রম, আপন ঐতিহ্যিক ধারার মহাসম্মিলনের প্রাসঙ্গিক সমস্ত আয়োজন। শুধু তাই নয়, বিশেষভাবে বিবেচিত হতে লাগল বিশ্বসভার নতুন জ্ঞান, আধুনিক চেতনা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সঙ্গে সৃষ্টিশীল উদ্যোম এবং এরই মাঝে নিজেকে পরিশুদ্ধভাবে বিকশিত করা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন নিজের ভাষায় যদি বিজ্ঞানচর্চা অবারিত না হয় তাহলে প্রযুক্তিবিদ্যার যথার্থ সুফল সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছাবে না। আপামর জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক এবং চালিকাশক্তি হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। কৃষির পশ্চাৎপদ সনাতন ব্যবস্থায় ‘আধুনিক’ যান্ত্রিক সভ্যতার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটাতে না পারলে সামগ্রিক অর্থনীতির কোন শুভ সূচনা হবে না। নিরক্ষর, মূর্খ, মূঢ় জনগোষ্ঠী নিজের মায়ের ভাষায়, মুখের ভাবে বিজ্ঞানকে আয়ত্তে আনতে না পারলে কৃষিতে নতুন অর্জন আসা কঠিন হয়ে যাবে। চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো ভ্রমণ করে তাঁর এই বদ্ধমূল ধারণা আরও জোরালো হয়। এসব দেশ মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে শুধু শিক্ষাকে নয়, প্রকৃতিকে জয় করেছে, বিজ্ঞানকে বশীভূত করেছে, শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে। এমনকি মান্ধাতা আমলের চাষাবাদ পদ্ধতিতে আধুনিককায়নের প্রযুুক্তি প্রয়োগ করেছে। এসব দেশে এক সময় প্রকৃতির অন্ধ পূজা ছিল, বংশানুক্রমিকভাবে মানুষের জীবনধারায় অসাড়তা ছিল, দৌর্বল্য আর শক্তিহীনতা ছিল, কিন্তু প্রয়োজনে তারা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে জেগে ওঠে, মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে সমস্ত কূপমন্ডূকতাকে অতিক্রম করেছে। ফলে দেশ সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে পৌঁছতে সময় লাগেনি। শুধু গুটিকয়েক স্বনামধন্য শিক্ষিত মানুষের ভূমিকায় এই অসাধ্য সাধন হয়নি। সব মানুষের সার্বিক অংশগ্রহণের সার্থক প্রয়াসের সুফল দেশ ও জাতি মিলিতভাবে ভোগ করছে। শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে উন্নয়নের সমস্ত সূচকে মানুষের সফলতা নিয়ে আসা সম্পর্কে কবির ভাবনা যে কত আধুনিক, মাঙ্গলিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ছিল তা আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। সঙ্গত কারণে তাঁর চিন্তা-ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক অপরিহার্যতাও বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায়ই শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথের এই যৌক্তিক বাণী আজও আমরা সফলভাবে অর্জন করতে পারিনি। শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা এখনও সেভাবে সর্বজনীন হয়নি। বিভিন্ন উপায়ে বাইরের ভাষার চর্চা ও অনুশীলন এতটাই বেড়েছে নিজের ভাষার মান সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আরও ভিন্ন মাত্রায় সর্বসাধারণের জীবনের মানোন্নয়ন না ঘটিযে জ্ঞানচর্চার পরিশুদ্ধ প্রতিবেশকে জটিল করে তুলেছে। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে কোচিংনির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে কোন্ গন্তব্যে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তা সত্যিই গবেষণার দাবি রাখে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আহরণে ছাত্রছাত্রীদের যে পরিমাণ দিগি¦দিক ছুটে বেড়াতে হয় সেটাও জাতির জন্য কতখানি মঙ্গল সময়ই তা বলে দেবে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব জগতও কি অতখানি নির্মল আর কল্যাণকর? সেটা বলাও কি খুব সহজ? পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনের অদম্য তাড়নায় শুধু জিপিও-৫ পাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ এই মুহূর্তে না ছাত্রছাত্রীর না তাদের অভিভাবকদের আছে। সমাজ-সংসার জীবন বিচ্ছিন্ন এই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি কোন সুনির্দিষ্ট পথপরিক্রমায় এগুলে সেটাও আজ সবার ধারণার অতীত। ভাল ফল করে কোন একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করা এখানকার সময়ের প্রজন্মের জীবনের ব্রত। এই ব্রত পালনের সুবর্ণ সময়টুকু আমাদের জন্য এত কঠিন ছিল না। আমরা নিজের মেধা ও মননকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে সুস্থ স্বাভাবিক ধারায় পরিচালিত করতে কিছুটা হলেও সফলকাম হয়েছিলাম। বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকরাও তাদের সেই প্রয়োজনীয় সময় অতিক্রান্ত করেছেন নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ। তাদের অভিভাবকরা শুধুমাত্র বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছেন। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা কোন্ পথে লক্ষ্য স্থির করবেন। তাদের সন্তানের জন্যেও সেই কাক্সিক্ষত পথ অবারিত ও অবাধ থাকা বাঞ্ছনীয়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনাও ছিল ঠিক তেমনই।
×