ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে গুজব ছড়ানো নওশাবা রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৬ আগস্ট ২০১৮

 ফেসবুকে গুজব ছড়ানো নওশাবা রিমান্ডে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতেই ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছিল অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ। নওশাবাকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আন্দোলনকে দিনের পর দিন টিকিয়ে রাখারও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল নওশাবার। আন্দোলনকারীদের উস্কে দিতে তিনি সরকার দলীয় লোক ও পুলিশের হামলায় চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও ছাত্রী ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের হত্যার পর তাদের লাশ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হয়। আর তাতে কাজও হয় বিদ্যুৎ গতিতে। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের নামে দুষ্কৃতকারীরা ধানম-ি আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে। অফিসের ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালায়। যদিও শেষ পর্যন্ত এমন খবরের কোন সত্যতা মেলেনি। পুরোটাই ছিল গুজব। গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এ ঘটনার পর থেকেই বিক্ষোভে রাজধানীসহ সারাদেশ ছিল উত্তাল। গত শনিবার বিক্ষোভের সপ্তম দিনে অন্যান্য দিনের মতো বিকেলে ধানম-িতে শিক্ষার্থীরা পুরো রাস্তা দখল করে নেয়। তারা রাস্তায় যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। এ সময় মানুষকে ব্যাপক হয়রানি করেছে শিক্ষার্থীরা। অনেক বয়স্কমানুষকে অপমান অপদস্ত করেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সারাদেশের সাধারণ মানুষ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ঠিক ওই সময় ধানম-িতে শিক্ষার্থীদের আড়ালে একদল দুর্বৃত্ত আচমকা হামলা চালায়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও হামলাকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। ঠিক এই সময়টিকেই বেছে নেন অভিনেত্রী নওশাবা। ঢাকা এ্যাটাক চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রী ফেসবুক লাইভে হাজির হন। তিনি ফেসবুক লাইভে হাঙ্গামায় চার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং চার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে খবর জানায়। আর হামলার কারণে যারা আটকা পড়ে তাদের উদ্ধার করার জন্য অনুরোধ জানান। এমনকি নিহতদের লাশ আওয়ামী অফিসে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। বিদ্যুত গতিতে খবর বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে দেয়। অফিসের বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালায়। শেষ পর্যন্ত কিছুই না পেয়ে হতাশ হয় আন্দোলনকারীরা। পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করে। এমন ঘটনার পর থেকেই নওশাবার তথ্য যাচাই-বাছাই করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তদন্তে বেরিয়ে আসে পরিকল্পিতভাবে নওশাবার গুজব ছড়ানোর বিষয়টি। শনিবার রাতেই নওশাবাকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় নওশাবাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। র‌্যাব- ১ এর ডিএডি আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। র‌্যাব নওশাবাকে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। রবিবার মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা নওশাবাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক মাজহারুল হক রিমান্ডের আবেদন বাতিল করে নওশাবাকে ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক তদন্তে নওশাবার ফেসবুক লাইভে দেয়া তথ্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই পরিকল্পিতভাবে তিনি মৃত্যু ও ধর্ষণের খবরটি ছড়িয়ে ছিলেন। নওশাবার লাইভ দেখা অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দারা। তারা জানিয়েছে, নওশাবার লাইভ দেখে তারা ভেবেছিল অভিনেত্রী ওই সময় ঘটনাস্থলের আশপাশেই ছিলেন। তার ফেসবুক লাইভে আসার ভিডিওটি অল্প সময়ের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, একঢিলে তিনপাখি মারতে চেয়েছিলেন নওশাবা। প্রথমত দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার অংশ হিসেবে ফেসবুকে মিথ্যা খবর ছড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত সারাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পাওয়ার আশায় এমন কাজ করেছিলেন। তৃতীয়ত দেশের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হতেই নওশাবা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ফেসবুক লাইভে এসে আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেছিলেন। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে জানান, নওশাবা আগাগোড়াই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। গত কয়েক দিনে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে আন্দোলনকারীদের আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের খাওয়া দাওয়া, পানি সরবরাহ ও নাস্তার ব্যবস্থা করেছেন। এখন পর্যন্ত তদন্তে নওশাবা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই ফেসবুক লাইভে এসে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আন্দোলনকারীদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে উস্কানি দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে তার পরিচিতি আরও ব্যাপক করতে এবং কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে নিজেকে জনপ্রিয় করার কৌশল হিসেবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ফেসবুক লাইভে এসে আন্দোলন সম্পর্কে কথা বলেছেন। কোর্ট রিপোর্টার জানান, শুনানীকালে আসামির জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী এ এইচ ইমরুল কাউছার। তিনি বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই শিক্ষার্থীর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন। এই আসামিও তাই। তিনি ঘটনার সময় শূটিং-এ ছিলেন। ওই সময় জনৈক রুদ্র তাকে ফোন করে ওই তথ্য দেয়। তিনি সরল মনে তা প্রকাশ করেন। এই সময় বিচারক বলেন, তিনি তো খ্যাতনামা অভিনেত্রী, মডেল ও সমাজের একজন সচেতন ব্যক্তি। তিনি কোন কিছু যাচাই না করে কিভাবে এমনটি করলেন। এই সময় আইনজীবী বলেন, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শুনে ইমোশনাল হয়ে কাজটি করেছেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে ফিসবুকে রিজয়েন্ডারও দিয়েছেন। এ সময় তাকে ভীত ও অশ্রুসিক্ত দেখা যাচ্ছিল। এর আগে গত শনিবার রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে নওশাবাকে আটক করে র‌্যাব।
×