ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ॥ নিরাপদ সড়ক চাই

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৬ আগস্ট ২০১৮

প্রসঙ্গ ॥ নিরাপদ সড়ক চাই

মাহমুদুল আলম খান বেনু ॥ ২৯ জুলাই রবিবার দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে ‘জাবলে নূর’ পরিবহনের একজন অদক্ষ বাসচালকের বেপোরেয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম (যার বাবা নিজে একজন দূরপাল্লার বাস চালক) এবং দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম রাজীবের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং বাসচাপায় আরও ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এমন ঘটনার পর সারাদেশে লাখ-লাখ কোমলমতি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক দাবিতে এবং ঘাতকের মত্যুদ-ের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভের কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের আড়াল কুচক্রী মহলের মদদে গত কয়েকদিনে প্রায় ৫০০ যানবাহন ভাঙচুর করা হয় এবং অন্তত ১০টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দিয়া এবং রাজীবের মৃত্যুতে সারা জাতি এবং সব শ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত শোকাবিভূত এবং এই হত্যাকা-ের বিচার চাইছে। কারণ, এটা কোন এ্যাক্সিডেন্ট নয় এটা একটি হত্যাকা-। একই পরিবহনের একটি বাস আর একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে শোকাহত হয়েছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং দোষীদের উপযুক্ত বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে দিয়ার বাবাকে ও রাজীবের মাকে সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন এবং সবধরনের সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ওই পরিবারবর্গকে গভীরভাবে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং নিরাপদ সড়কের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বহুবার বিআরটিএ তে আকস্মিক অভিযানও চালিয়েছেন এবং হাতেনাতে দালাল ও দুর্নীতিবাজদের ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যে সমাজের এবং যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে, একজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে একদিনে তা নির্মূল করা সম্ভব নয়। আমি পত্রিকায় দেখেছি যোগাযোগমন্ত্রী নিজে বাসে উঠে ড্রাইভারের লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস চেক করেছেন এবং তখন এ নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আর এখন ছেলেমেয়েরা গাড়ি চেক করে বড় বড় সরকারী কর্মকর্তা ও স্বনামধন্য ব্যক্তিদের গাড়ির কোন কিছুই ঠিকঠাক পাচ্ছে না, তখন তাদের সবাই বাহবা দিচ্ছেন। হ্যাঁ এটা মন্ত্রী সাহেবের বা ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ নয় এবং প্রথমত সেই গাড়ির মালিকের কর্তব্য সব কাগজপত্র আপডেট রাখা এবং ড্রাইভারের দায়িত্ব সঠিক লাইসেন্স নিয়ে বিধি মোতাবেক গাড়ি চালানো। কিন্তু আমরা কেউ কি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি। বিআরটিএর দায়িত্ব বিধিমোতাবেক গাড়ির সব কাগজপত্র পরীক্ষা ও নবায়ন করা এবং কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব চলমানরত সব গাড়ির কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কি-না তা পরীক্ষা করা। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে কি আর করা যাবে। বিস্তারিত আর বললাম না হয়ত পত্রিকায় দেখে থাকবেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যিনি পরিবহন সমিতির সভাপতি, তিনি যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন না কেন, তার বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ থাকলে তাৎক্ষণিতভাবে পদত্যাগ করতেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে কেন? যা হোক, পদত্যাগের কালচার আমাদের দেশে কোনকালেই ছিল না। ঘটনায় দেখা যাচ্ছে তিনবারের ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নেত্রীবৃন্দ ভীষণভাবে উৎফুল্ল এবং সরকারের পদত্যাগ চাইছেন। তাদের সময় সড়ক ও নৌপথে যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এগুলো কি স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ছিল? তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে একটি করে ছাগল দেয়া ছাড়া আর কিছুই তারা করেননি। বরঞ্চ তখনকার একজন মন্ত্রী নিহতের বাসায় গিয়ে বলেছিলেন ‘আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গিয়েছে।’ কই তখন তো তারা পদত্যাগ করেন নাই। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কতগুলো বিমান ধ্বংস হয়েছিল এবং সমুদ্রবন্দরে কতগুলো জাহাজ ডুবে গিয়েছিল বা চড়ে উঠে গিয়েছিল, তার জন্য কি তারা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন বা পদত্যাগ করেছিলেন। আজকে তারা দিয়ার বাবার কাছে গিয়ে সমবেদনা জানাচ্ছেন এটাকে আমি সাধুবাদ জানাই এবং তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে আরও ভাল হতো। এরশাদ সাহেব ও দিয়ার বাসায় গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন, হত্যার বিচার চেয়েছেন, তাকেও ধন্যবাদ। তবে তাকে জবাব দিতে হবে ১৯৮৩ সালে তোপখানা রোডে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে যখন ছাত্র নেতা সেলিম ও দেলোয়ারকে হত্যা করিয়েছিলেন তার জন্য কি পদত্যাগ করেছিলেন এবং জাতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলেন? তাও তো শাজাহান খান দিয়ার বাবার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছেন। মনে করবেন না এদেশের জনগণ বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সরকারের কথা ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন, হত্যা, গুম ও খুন। বাঙালী জাতি কোনদিন ১৫ আগস্টকে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকারীদের এবং তাদের মদদদাতাদের এবং পরবর্তীকালে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয়, প্রশ্রয় দাতাদের ক্ষমা করবে না। যেমনভাবে ক্ষমা করবে না ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেট হামলাকারীদেরও। দু-একজন ব্যারিস্টার আছেন যারা প্রেসক্লাবে বা পত্রপত্রিকায় বক্তৃতা বিবৃতি দিতে এবং সব সময় সুটেট-বুটেট থাকতে পছন্দ করেন ও লম্বা লম্বা কথা বলেন। তাদের বলব আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখুন। এদেশ স্বাধীন করেছে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গতাজের নেতৃত্বে কৃষক ও গরিবের সন্তানরা। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ফসল ভোগ করছেন আপনারা। সেই রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পেলে আপনাদের কষ্ট হয়। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা মানববন্ধন হোক, সমাবেশ হোক, সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছে তাদের প্লেকার্ডে। লিখেছে জাতি নতুন করে নির্মাণ করবে। ভাল কথা, কিভাবে নির্মাণ করবে? একজনকেও প্লেকাডে লিখতে দেখি নাই ‘নকলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চাই’। কারণ নকলের সহিত কিছু অসাধু কর্মকর্তা, কিছু দুর্নীতিবাজ শিক্ষক ও অভিভাবক এবং কিছু নকলবাজ ছাত্রছাত্রী জড়িত। ছাত্রছাত্রীদের সৎশিক্ষা এবং সুশিক্ষা দিতে না পারলে এ রকম ঘাতক চালক ও মালিক আরও তৈরি হবে। তাই আমি মনে করি সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হচ্ছে নকলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করা। যাতে প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রী একজন মেধাবী, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হতে পারে এবং পরবর্তীকালে তার কর্মস্থলে তার প্রয়োগ ঘটাতে পারে। এ ব্যাপারে আমি গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের একটি বই ‘লিভিং হিস্ট্রি’ কিছু উদ্ধৃতি দেই। অনেকই জানেন ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৯২ সালে, তারও ১০ বছর পূর্বে তিনি ছিলেন আরাকানসের গবর্নর। তখন আরাকানস ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দরিদ্র স্টেট এবং এর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ভীষণ বিপর্যস্ত। তাই বিল ক্লিনটন প্রথমেই ঠিক করলেন কিভাবে আরাকানসের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করা যায়। সেই জন্য হিলারির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির শিক্ষা উন্নয়নে প্রথম যে পরামর্শ দিয়েছিল তা হলো ‘আদর্শ ছাত্র তৈরি করতে হলে আদর্শ শিক্ষক তৈরি করতে হবে।’ শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষককের মান বাড়াতে হবে। আর আমাদের দেশের অবস্থান পাঠক আপনারই বিবেচনা করুন। আমরা চাই ঘাতকের বিচার অবশ্যই হোক তবে তা হতে হবে আইন অনুযায়ী। আইন হতে হবে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে। অবশ্যই আমরা নিরাপদ সড়ক চাই, কথায় নয় কাজে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত কয়েকদিন যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায় সাধারণ মানুষ যে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন, সেটা আমার কাছে যতটা বেদনার তার চেয়ে বেশি বেদনার ‘লেগুনার যে বাচ্চা ছেলেটি, বাসের হেলপার যে বাচ্চা ছেলেটি’ সারাদিন কাজ করে যা উপার্জন করত এবং রাত্রে সে তা তার মায়ের কাছে তুলে দিত, হয়ত তা দিয়ে তাদের সংসার চলত। গত কয়েকদিন তাদের সংসার কিভাবে চলছে আমরা কি তা একবার ভেবেছি? এই সমাজ, এই জাতি, এই রাষ্ট্র কি আরও মানবিক হতে পারে না? লেখক : মুক্তিযোদ্ধা [email protected]
×