ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনী জোটে জামায়াত থাকবে না- তৃণমূল নেতাদের সাফ কথা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৫ আগস্ট ২০১৮

নির্বাচনী জোটে জামায়াত থাকবে না- তৃণমূল নেতাদের সাফ কথা

শরিফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন অবস্থাতেই ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতকে বিএনপির নির্বাচনী জোটে দেখতে চান না দলের তৃণমূল নেতারা। তাদের সাফ কথা প্রয়োজনে জোটের বাইরে থাকা আরও কিছু সমমনা দলকে নিয়ে নির্বাচনী জোট করা যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী জোটে জামায়াত থাকবে না সেটাই তারা দেখতে চান। জামায়াত ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোটে থাকতে পারে তবে নির্বাচনী জোটে জামায়াত থাকবে না এটাই শেষ কথা। কোন অজুহাতে জামায়াতকে নির্বাচনী জোটে রাখলে তৃণমূল নেতারা তা মেনে নেবেন না। সেক্ষেত্রে তারা নির্বাচনকালে নিষ্ক্রিয় থাকবে। সারাদেশের সকল বিভাগের প্রায় চারশ’ তৃণমূল নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে দুইদিনব্যাপী মতবিনিময়কালে তাদের এ অবস্থান তুলে ধরেন। সূত্র মতে, দুইদিনব্যাপী চারদফা মতবিনিময়কালে প্রতিটি জেলা থেকে আসা তৃণমূল নেতারা সাম্প্রতিক সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্থায়ী কমিটির নেতাদের কাছে অবিলম্বে জামায়াত ছাড়া নির্বাচনী জোট করার ঘোষণা দেয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাল ফল করতে হলে বিএনপিকে সিলেটবাসীর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কারণ, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে মেয়র পদে প্রার্থী দেয়ায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। সে সঙ্গে সাধারণ মানুষ বিএনপির পক্ষে রায় দেয়। এর ফলে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক দলকে বিজয় উপহার দেন। জানা যায়, কোন কোন তৃণমূল নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের কাছে বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে নির্বাচনী জোটে নিতে হলে ৩০ থেকে ৪০টি আসন তাদের ছেড়ে দিতে হবে। এ সব আসনের অধিকাংশেই বিজয়ী হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু জামায়াতকে নির্বাচনী জোটে না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি গণফোরাম, বিকল্পধারা, জাসদ (রব), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্যকে নির্বাচনী জোটে নিয়ে এই ৩০ থেকে ৪০টি আসন ছেড়ে দিলে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। এতে একদিকে বিএনপির নির্বাচনী জোটের ইমেজ বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি হয়েও দেশের যে সকল মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় না তাদের ভোট বিএনপি টানতে সক্ষম হবে। এতে দল ও জোটের ভোট বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে বিএনপি লাভবান হবে। ফলে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো ভোটের ফলাফলে বিএনপিই বেশি লাভবান হবে। তৃণমূল বিএনপি নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকেও বাদ দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন। তবে এর বিপরীতে কোন কোন তৃণমূল নেতা বলেছেন, এখনই জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দেয়া ঠিক হবে না। বরং আপাতত রাজনৈতিক জোটে রেখে নির্বাচনী জোট থেকে দূরে রাখতে হবে। তা না হলে আওয়ামী লীগ কৌশলে জামায়াতকে তাদের পক্ষে নিয়ে নেবে। তাই জামায়াতকে রাজনৈতিক জোটে রেখে বিএনপি জোটের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারলে বিএনপি লাভবান হবে। তৃণমূল নেতারা এ ছাড়াও ত্যাগী ও মেধাবী নেতাদের নিয়ে দলের সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জোরালো আন্দোলন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। এ সময় স্থায়ী কমিটির পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলে তৃণমূল নেতাদের মনোভাবের বিষয়টি জানানো হবে এবং অবিলম্বে দলীয় হাইকমান্ডের অবস্থান তাদের জানিয়ে দেয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়া এক তৃণমূল নেতা জনকণ্ঠকে জানান, বাস্তবতার আলোকে নির্বাচনী জোটে জামায়াতকে না রাখাসহ বেশ ক’টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের এ সব প্রস্তাবের বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানিয়ে দেয়া হবে। তবে আমরা আশা করছি নির্বাচনী জোটে জামায়াতকে না রাখলে সিলেটের নির্বাচনের মতো জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি অধিকতর ভাল ফল করবে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকেও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির প্রতি চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরও দলের তৃণমূল নেতারা জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে দাবি জানিয়েছিল। প্রসঙ্গত, কারাগারে যাওয়ার আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর পর বিএনপি মহাসচিব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তবে খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক’টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জামায়াতের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়। বিএনপি জামায়াতের বিষয়ে স্পষ্ট কোন অবস্থান না জানানোর কারণে ওই ঐক্য প্রক্রিয়া থমকে যায়। কিন্তু সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে বার বার অনুরোধ করেও জামায়াতের মেয়র প্রার্থীকে বসাতে না পারায় ওই দলটির প্রতি কিছুটা নাখোশ হয়। এর পর ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একমাত্র সিলেটে বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের টনক নড়ে। আর বিএনপির তৃণমূল নেতাদের নির্বাচনী জোটে জামায়াত না রাখার দাবির পর দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও নড়েচড়ে বসে। জানা যায়, তৃণমূল নেতাদের দাবি অনুসারে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে নির্বাচনী জোটে জামায়াত না রাখার সিদ্ধান্ত এলে শীঘ্রই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, অধ্যাপক ডাঃ একিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী জোটে আসার ঘোষণা দেবে। এ ছাড়া আরও ক’টি ছোট দল এ জোটে আসবে। তবে এর বিপরীতে ২০ দলীয় জোটের জামায়াত সমর্থিত ক’টি ছোট দল এ নির্বাচনী জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তবে প্লাস-মাইনাস করে শেষ পর্যন্ত বিএনপির কিছুটা হলেও লাভ হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে যে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি এখন আর সে অবস্থায় থাকতে চায় না। এ অবস্থার অবসানে নানামুখী কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা। বিএনপি চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সারাদেশের সকল বিভাগের প্রতি জেলা থেকে ৫ জন করে নেতাকে ডেকে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা। এ সময় তৃণমূল নেতারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মত দেন। তবে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জোরালো আন্দোলনের পক্ষেও মত দেন তারা। আর নির্বাচনী জোটে যেন জামায়াত না থাকে সে বিষয়েও সতর্ক করেন তারা। দুইদিনব্যাপী রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় সভায় শুক্রবার রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এবং শনিবার সিলেট, প্রস্তাবিত কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুইদিনব্যাপী সারাদেশের সকল জেলা থেকে আগত তৃণমূল নেতাদের মতবিনিময় সভায় যেসব প্রস্তাব ওঠে এসেছে সেগুলো বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। শীঘ্রই এসব প্রস্তাব দলীয় হাইকমান্ডের কাছে লিখিতভাবেই তুলে ধরা হবে। এর পর যে সিদ্ধান্ত আসবে তা তৃণমূল নেতাদের জানিয়ে দেয়া হবে। আশা করা যাচ্ছে দলীয় হাইকমান্ড তৃণমূল নেতাদের দেয়া প্রস্তাবগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
×