ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারী যৌবনের ২৮ ভাগ সময় ব্যয় করে প্রজনন ও গর্ভধারণে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ আগস্ট ২০১৮

নারী যৌবনের ২৮ ভাগ সময় ব্যয় করে প্রজনন ও গর্ভধারণে

সমুদ্র হক ॥ দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বালিকাদের বধূ হওয়া। দেশে প্রতি বছর ২২ লাখ শিশু জন্ম গ্রহণ করে যোগ হচ্ছে জনসংখ্যার সঙ্গে। জন্ম নেয়া এই শিশুদের একটি অংশ কিশোরী বা বালিকা মায়ের। যাদের বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছরের নিচে। জনসচেতনতা, স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, পারিবারিকভাবে সচেতন থাকা, জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা, ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা বিশেষ হটলাইন ১০৯ নম্বরে খবর দেয়া ও সর্বোপরি প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ের হার গত পাঁচ বছরে ১৭ শতাংশ কমেছে। তবে তা এখনও সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেনি। যে কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে না। দেশে বাল্যবিয়ে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বগুড়ার শাজাহানপুর ও কাহালু উপজেলায়। যে হার ৭০ শতাংশ। উল্লেখ্য, দেশে বাল্যবিয়ের হার এখনও ৬২ শতাংশ। বগুড়ায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে একজন শিক্ষাবিদ বাল্যবিয়ে নিয়ে তার পর্যবেক্ষণে জানালেন, বাল্যবিয়েরও একটা মৌসুম তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কিশোর কিশোরীদের একটি অংশ বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। কেউ প্রেমে পড়ে গোপনে বিয়ে করছে। কারও বিয়ে হচ্ছে মা-বাবার প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে। আবার কোন বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়ের বালিকা বয়সেই বিয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের বিয়ের কোন খবর মেয়ের বান্ধবী ও স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে পৌঁছার সঙ্গেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর বাইরে বালিকাদের যে বিয়ে হচ্ছে তা ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে ঠেকানোর পর অভিভাবক মেয়েকে দূরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ের কাজ সারছে। যা আর প্রকাশ হচ্ছে না। এভাবে বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। এই বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে বালিকারা সন্তান জন্ম দিচ্ছে। এভাবে সন্তান জন্ম নেয়ায় মা ও শিশু উভয়েই ঝুঁকির মধ্যে থাকছে। রক্ত স্বল্পতায় মা ভুগছে নানা রোগ ব্যাধিতে। পুষ্টিহীনতায় সন্তান বেড়ে উঠছে খর্বাট ও মেধাহীন হয়ে। অন্যদিকে বাল্যবিয়ের হার কমেও যাচ্ছে। শিক্ষিত মেয়েদের বেশিরভাগই এখন আর কম বয়সে বিয়ে করতে চায় না। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষা শেষে ও চাকরির পর বিয়ের ভাবনা চিন্তা করছে। এক জরিপে দেখা গেছে, যে পরিবারের মেয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠছে সেই পরিবারে বাল্যবিয়ে প্রায় শূন্যের কোঠার নেমেছে। তবে এ জন্য মা-বাবাকেও সচেতন হতে হয়েছে। বিয়ের পর এই মেয়েরা সন্তান জন্ম দিচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এই বিষয়ে বিশিষ্ট গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ গুলশান আরা বলেছেন, মেয়েদের সন্তান ধারণের উপযুক্ত সময় ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। দেশে মেয়েদের বিয়ে ২০ বছরে হলে সামগ্রিকভাবে জন্ম হার কমে যাবে (জন্মনিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে)। পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যে মেয়েরা দাবি করে মেয়েদের বিয়ের সর্বনি¤œ বয়স ২১ বছরে নিয়ে এসেছে। এক তথ্যে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের একজন মেয়ে গর্ভধারণ ও প্রজনন প্রক্রিয়ায় যৌবনের মাত্র ১০ থেকে ১২ ভাগ ব্যয় করে। ভারতে এই হার ১২ থেকে ১৬ ভাগ। সেখানে বাংলাদেশের নারী ব্যয় করে যৌবনের ২৫ থেকে ২৮ ভাগ সময়। যা সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ার বড় অন্তরায়। জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনএফপিএর এক জরিপে বলা হয়েছে দেশে মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোর কিশোরী। যে সংখ্যা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে কিশোরীর সংখ্যা ১ কোটি ৮১ লাখ ৯০ হাজার। এই ‘টিনএজ’দের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। এই বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেগের মধ্যে থাকে যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছর। যে সংখ্যা ৯০ লাখ ৯৫ হাজার। যার ৪০ লাখ ২০ হাজার মেয়ে বিবাহিত। এই মেয়েদের ৪৫ শতাংশেরও বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করে না। তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি গ্রহনের ইচ্ছা থাকলেও পূরণ হয় না। এদের ১৮ শতাংশ প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পায় না। যে কারণে জন্ম হার কমছে না। সরকারী এক হিসাবে বলা হয়েছে, দেশে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা সাম্প্রতিক প্রজনন হার ২ দশমিক ১। এই হারের একটি অংশ কিশোরী মাতার। বগুড়া জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে ইতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। বাল্যবিয়ে রোধে আইন একটি মাধ্যম। তবে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো নারী শিক্ষা ও সমাজ সচেতনতা। বর্তমান প্রজন্ম বিষয়টি বুঝে এগিয়ে এসেছে। এই এগিয়ে আসাকেই কাজে লাগাতে হবে। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ত্বাইফ মামুন বলেন, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলে তাদের শৈশবের আনন্দের দিনগুলো কেড়ে নেয়া হবে। যা অমানবিক। এ ছাড়াও প্রজনন স্বাস্থ্যগত যে সমস্যা দেখা দেয় তা অভিভাবকের সামনেই ঘটে। এ সমস্যা আজকের মেয়ে শিশুকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়।
×