ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বারো বছরের হাসান বীরদর্পে দুই বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৫ আগস্ট ২০১৮

বারো বছরের হাসান বীরদর্পে দুই বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে

আজাদ সুলায়মান ॥ বারো বছরের হাসান রাজধানীতে বীরদর্পে লেগুনা চালাচ্ছে গত দুই বছর ধরে। তার মানে দশ বছর বয়স থেকেই সে চালক হিসেবে কাজ করছে। তার নিজের কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। গাড়িটিরও নেই ফিটনেস। লক্কড়-ঝক্কড় এই গাড়িটির ব্র্রেকও ঠিক নেই। ফেসবুকে এই ছবিটি ভাইরাল হয়ে গেলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের ২৫ হাজার জনবলের কেউ তাকে কখনও ডিস্টার্ব করেনি। পুলিশকে ম্যানেজ করেই গত দু’বছর ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকায়। সে একা নয়-তার মতো এমন শত শত হাসান ৮-১০ বছর বয়সেই লেগুনা, ইজিবাইক ও অন্যান্য যানবাহন চালাচ্ছে পুলিশের সামনে দিয়েই। পুলিশও তাদের বাহনে যাত্রী হয়। লাইসেন্সবিহীন যানবাহন ও চালকের পরিসংখ্যানটা আরও ভয়াবহ। দেশে মোট ৫৫ লাখ গাড়ির যানবাহনের মধ্যে ২০ লাখেরই কোন রেজিস্ট্রেশন নেই। এগুলোর বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৩৯ হাজার। যাদের মধ্যে দক্ষ ও পেশাদার চালকের লাইসেন্স আছে মাত্র ১২ লাখ ১৫ হাজারের। স্থানীয়ভাবে তৈরি থ্রি-হুইলার চলছে ৩ লাখেরও বেশি- যেগুলোর বেশির ভাগই চালাচ্ছে ১০ থেকে ১৬ বছরের কিশোর ও তরুণরা। দেশের পরিবহন সেক্টরের এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের চরম ব্যর্থতার কারণেই সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নেমে এসেছে। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি রাস্তা। এসব কারণেই গত সাড়ে ৩ বছরে ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সড়কের মৃত্যুফাঁদে, পঙ্গুত্ববরণ করেছে ৬২ হাজারেরও বেশি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মাঝেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিস্ফোরন্মুখ হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। গত ছয়দিন ধরে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এখন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ঢাকা মহানগর পুলিশ তড়িঘড়ি করে কোন রকম পূর্বপ্রস্তুতি না নিয়েই আজ রবিবার থেকে শুরু করছে ট্রাফিক সপ্তাহ। অথচ নিয়মিত ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহ পালন করা হলে, সড়ক মহাড়কের যান চলাচলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হলে আজকের এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। শুধু যান চলাচলের ওপর পুলিশের নিয়মিত তদারকি ও ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পরিবহন সেক্টর চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাজধানীতে কেন নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ নিয়মিত পালন করেনি পুলিশ জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। সব সময়েই চলছে। কাল রবিবার থেকেই শুরু হবে। এছাড়া পুলিশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সড়কের শৃঙ্খলায় ফেরাতে। আপনার খুব শীঘ্রই দেখতে পারবেন। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন সাবেক কমিশনার জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশ আর বিআরটিএ-এর। শুধু রাজধানীর উদাহরণ দিয়েই বলতে পারি, এখানে কতগুলো যানবাহনের বিপরীতে কতগুলোর ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স রয়েছে তার দেখভাল করার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। বিআরটিএ ঠিকমতো চালক ও যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করেছে কি না, তা তো রাজপথেই মনিটর করে ধরার জন্য একজন সার্জেন্টই যথেষ্ট। কোন গাড়ি আইন মেনে সঠিক লেনে নির্দিষ্ট গতিতে চলছে কি না নাকি বেপরোয়া চলে- তার জন্য একজন ট্রাফিক কনস্টেবলই যথেষ্ট। আবার কনস্টেবল ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটার দেখভাল করবে সার্জেন্ট। তার কাজের তত্ত্বাবধান করবে পরিদর্শক, সহকারী কমিশনার, যুগ্ম-কমিশনার ও কমিশনার। এরাই তো যথেষ্ট। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, এক সময় রাজধানীতে নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হতো। নগরবাসী তাতে সতর্ক হয়ে যেত। সপ্তাহব্যাপী ট্রাফিক পুলিশের বাড়তি তৎপরতা চোখে পড়ত। এতে অনেক অবৈধ যানবাহন ও চালক ধরা পড়ত, জেল জরিমানা হতো, শাস্তি হতো। ফলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত। কিন্তু এখন এগুলো চোখে পড়ছে না। যে কারণে বিচারপতি থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সাংসদ ও সচিবের গাড়িগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আটক করে জাতির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। এ শুধু পুলিশের ব্যর্থতা নয়, জাতির জন্য বড় লজ্জার। জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা জনকণ্ঠকে বলেন, ট্র্রাফিক পুলিশের কি দায়িত্ব কিভাবে তারা ডিউটি পালন করবে, কিভাবে সড়কের যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষা করবে সেটা আইনেই সুস্পষ্ট করা আছে। প্রত্যেকেই যদি নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে তাহলে তো আর এমন পরিস্থিতি হতো না। আপনার সময়ে ঢাকা মহানগরে নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ হতো, পুলিশ কমিশনার নিয়মিত বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্ট ও থানাগুলো পরিদর্শন করতেন। এখন সেটা চোখে পড়ে না। এটা কি স্বাভাবিক মনে করেন প্রশ্ন করা হলে নূরুল হুদা বলেন, একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বা পরিদর্শকের কাজ সঠিকভাবে মনিটর করার জন্য তার ওপর সহকারী কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনার ও যুগ্ম-কমিশনার থাকেন। তারাই দেখভাল করেন। কমিশনারকেই যে করতে হবে এমনটি নয়। করলে অবশ্যই ভাল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা সব সময়ই কাজ করছি। এখন আরও জোরদার পদক্ষেপ নেয়া হবে। আমি ইতোমধ্যে কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছি নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করতে। এদিকে শনিবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই জরুরী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ঘোষণা দেন-আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে ট্রাফিক সপ্তাহ। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেই এ পদক্ষেপ। এই সপ্তাহে ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে শুরু করে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি পর্যন্ত- যে কোনভাবে আইন লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এ ঘোষণা দেন। নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনসহ সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, সারাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করব আমরা। এই সময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্স ছাড়া চালক, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলসহ কোনভাবে ট্রাফিক আইনের ব্যত্যয় হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন না মানার যে চেষ্টা, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষেত্রে কেবল যানবাহনকে দায়ী না করে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, আমাদের নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে ওঠা, ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও সেটা ব্যবহার না করে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বহুবিধ কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে, নানা সীমাবদ্ধ সত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করছি এ আইন বাস্তবায়নের। অনেক সময় পেশাজীবীদের স্টিকার লাগিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়। আরও একটি সমস্যা আমাদের ভৌত অবকাঠামো না থাকা। বাস টার্মিনাল নেই, যেসব আছে তা ডিপোতে পরিণত হয়েছি। আইন না মানার সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। একটি এলাকায় গেলে আমরা খুব ট্রাফিক রুল মানি, কিন্তু সেখান থেকে বেরোলে আর মানি না। সবার কাছে আহ্বান জানাই সব জায়গায় ট্রাফিক রুল মেনে চলার। বিশৃঙ্খলা নয়, শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আনতে হবে। আইন মানতে হবে, যারা আইন মানে না, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আইন প্রয়োগে আমাদের নৈতিক ভিত্তি দিয়েছে, আমরা এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এখন ট্রাফিক রুলের কঠোর প্রয়োগে উদ্যোগ নিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে রবিবার থেকে সারাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করবে পুলিশ। এখন আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাই।
×