ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গরুর গাড়ি এখন স্মৃতির জাদুঘরে

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৪ আগস্ট ২০১৮

 গরুর গাড়ি এখন স্মৃতির জাদুঘরে

ও কি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে..। এখন আর চাইয়া থাকলেও গরুর গাড়ি চোখে পড়ে না। আর গানও গায়না গাড়িয়ালরা। কালের পরিক্রমায় আধুনিকতার স্পর্শে উত্তরের নওগাঁ জেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি! গ্রামগঞ্জের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা গরুর গাড়ি এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। যা একসময় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে প্রচলিত ছিল। গ্রামবাংলায় গরুর গাড়িই যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল। এক সময় জনপদে এই বাহনের সরগরম অস্তিত্ব ছিল। সর্বত্র কদরও ছিল গরুর গাড়ির। মাত্র দুই যুগ আগেও পণ্য পরিবহন ছাড়াও বিবাহের বর-কনে বহনে বিকল্প কোন বাহন কল্পনাই করা যেত না। যেসব পরিবারে গরুর গাড়ি ছিল, তাদের কদরের সীমা ছিল না। কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরুর গাড়িতে কখনও জৈবসার (গোবর সার) কখনো গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত। সুপ্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরুর গাড়ির বহুল প্রচলন পরিলক্ষিত হতো। পায়ে চলার পথে মানুষ পশুর শ্রমে চালিত গরুর গাড়ি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ও বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। গরুর গাড়ি সাজিয়ে বর যেত বিয়ে করতে। বিয়ের পর নববধূকে নিয়ে ফের সেই গরুর গাড়িতেই বাড়ি ফিরত। বাংলা এবং বাঙালীর ঐতিহ্য গরুর গাড়ি আজ যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এখন অতীত। বিভিন্ন উৎসবপার্বণে এটি ছিল অপরিহার্য। আগে অনেকেরই এই গাড়ি ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। তখন গরুর গাড়ির ব্যাপক চাহিদা ছিল। গ্রামের বউঝিদের নাইয়োরে যেতে গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হতো অহরহ। সময়ের বিবর্তনে আজ গরুর গাড়ি চালক (গাড়িয়াল) না থাকায়, হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা গাড়িয়াল ভাইয়ের কণ্ঠে সেই অমৃত মধুর সুরের গান। গাড়ি চালানোর সময় আনন্দে গাড়িয়ালরা ঠিক এমন ভাবেই গান গাইতেন। আধুনিকতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল পেশাও। যা একদা ছিল বংশ পরম্পরায়। সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ধারকবাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন, আধুনিকায়ন সাধিত হয়েছে। আজ শহরের ছেলেমেয়েরা তো দূরে থাক গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরুর গাড়ির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত না। ইঞ্জিনের স্পর্শে আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক বাহনই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক বাহনই হারিয়ে যাচ্ছে দৃশ্যপট থেকে। তেমনি দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রকৃতিবান্ধব গরুর গাড়ি বহুবিধ কারণে বর্তমানে হারিয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও কালেভদ্রে দু’একটি গরুর গাড়ির দেখা মিললেও বর্তমানে তা যেন ডুমুরের ফুল। গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। নব্যপ্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানুষ এই বাহন ব্যবহার করে আসছে। ফ্রান্সের ফঁতান অঞ্চলে আল্পস পর্বতের উপত্যকায় একটি গুহায় গরুর গাড়ির যে ছবি পাওয়া যায়, তা থেকে জানতে পারা যায় খ্রিস্টের জন্মের ৩১০০ বছর আগে ব্রোঞ্চ যুগেও গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতাতেও যে গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল তার সপক্ষে প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও নানা অঞ্চল থেকে এক অক্ষবিশিষ্ট চাকাওলা নানা খেলনা পাওয়া গেছে। এগুলো থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১৫০০ সালের দিকে সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি কফিল উদ্দীন, তাহের ও আফজাল হোসেন বলেন, আগে আমাদের এলাকায় গরুর গাড়ির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ২০-২৫ বছর পূর্বে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কম হলেও একটি করে গরুর গাড়ি ছিল। অনেক বিত্তবান পরিবারে ২-৪টি পর্যন্ত গরুর গাড়ি ছিল। সে সময়ে অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের উৎস ছিল গরুর গাড়ি। এই গাড়ির ওপর নির্ভর করে চলত ওইসব পরিবারের সংসার। কিন্তু এখন বাস, মাইক্রোবাস, ভটভটি, ইজিবাইক, ভ্যান, নছিমন, করিমনসহ ইঞ্জিনচালিত নানা গাড়িতে এসব কাজ চলছে। উপজেলার জোয়ানপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মকবুল হোসেন জানান, এখন যেমন আমরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য প্রাইভেটকার বা মাইক্রো ক্রয় করে থাকি, ঠিক তেমনি আগে গ্রামের লোকজন গরুর গাড়ি তৈরি করে বাড়িতে রাখতেন। আপদ-বিপদে তা তারা বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি বলেও জানান তিনি। গোপালকৃষ্ণপুর গ্রামের মাহবুবুজ্জামান সেতু বলেন, গরুর গাড়ি এখন থেকে স্মৃতির জাদুঘরে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমরা চাই জাদুঘরে খুব যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে এটি সংরক্ষণ করা হোক। কারণ আধুনিকায়নের কাছে এটি এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। আগামী প্রজন্মের জন্য এগুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে। ঐতিহ্যের স্বার্থে এ বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×