ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৪ আগস্ট ২০১৮

পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশ

অপরিকল্পিত নগরায়ন, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের অবক্ষয়ের ফলে পৃথিবীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। মানুষ তার জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য দ্রব্য-সামগ্রী প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ করে থাকে। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা ও মানুষের বিলাসী জীবনের চাহিদা পূরণ করতে প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ এবং সংকটাপন্ন হচ্ছে প্রতিবেশগত ভারসাম্য। অপরিমিত রাসায়নিকের ব্যবহারে উর্বরতা হারাচ্ছে জমি, বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা, ভূগর্ভের পানি উত্তোলনে শূন্য হচ্ছে পানির স্তর, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানাবিধ প্রভাব। মানুষের অপরিণামদর্শী উন্নয়ন কর্মকা-ের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বনভূমি, নদী, জলাশয়, খাল, বিল ও ঝর্ণাধারা এবং প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য। ফলে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে দেশ এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রমের গতিধারা। এসব নানাবিধ প্রভাব মোকাবেলায় ২০০০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ একই উদ্দেশ্য পূরণকল্পে মিলিতভাবে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে অত্যন্ত আন্তরিক। সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে সরকার পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটি দূষণ, পাহাড় কাটা, জলাধার ভরাট, শিল্প বর্জ্য, বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য, চিকিৎসা ও গৃহস্থালীর বর্জ্য জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ বহুবিধ পরিবেশগত সমস্যা মোকাবেলাপূর্বক এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের গৃহীত এ সকল কার্যক্রম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শিল্প বিপ্লব মানুষের জীবন যাত্রাকে সহজ করেছে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা সামগ্রী অধিকতর কম পরিশ্রমে অর্জন করতে শুরু করে। অপরদিকে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী পরিবেশ দূষণও ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিভিন্ন গবেষকও বিজ্ঞানীগণ নিজ নিজ গবেষণা ও লিখনির মাধ্যমে তুলে ধরলেও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৭২সাল থেকে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় (United Nations Conference on the Human Environmet) সম্মেলনে শিল্পায়নের কারণে যে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমের যাত্রা শুরু এবং (United Nations Environment Program UNEP) সৃষ্টি। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশেও কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। তখন পরিবেশ দূষণের প্রধান বিষয় ছিল পানি দূষণ। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭৩ জারিপূর্বক দেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে ১৮(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করেছে। উক্ত অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং জীববৈচিত্র জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির নিরাপত্তা বিধান করবে। . ইট ভাটা সৃষ্ট বায়ুদূষণ বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বহুতল ভবন নির্মানে কংক্রিট, এ্যালুমিনিয়াম সিট, প্লাষ্টিক, কাঁচ, ফাইবার, স্টীল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশসহ বহু স্বল্পোন্নত দেশে ইমারত নির্মাণে প্রধানত ব্যবহার হচ্ছে ইট। আর এই ইট তৈরিতে ব্যবহার হয় প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মাটি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা নেয়া হয় কৃষি জমি থেকে যাকে প্রকৃতির বর্জ্যরে ঝুড়ি বলা হয়ে থাকে। পরিবেশ অধিদফতর এবং পবার মাঠ পর্যায়ের তথ্য মতে দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৯৭০০টি। এর মধ্যে প্রায় ১৮০০টির অধিক ড্রাম চিমনি বিশিষ্ট ইটভাটা ৪৭০০টি জিগজাগ বা উন্নত জিগজাগ, ৩০৭৫টি ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি ভাটা এবং ১২৫টি এইচএইচকে ও টানেল ভাটা। ৪৮২৫টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স রয়েছে, যা মোট ভাটার ৫০%বা ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা ছাড়া ভাটাসমূহের ৬০%। এসব ইটভাটায় ২৭ লাখ ৬৩ হাজার টন কাঠ এবং ৬৭,১৫,০০০টন কয়লা পোড়ানো হয়। এসকল ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ ড্রাম চিমনি ও ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনির ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ইটাভাটাই নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থাপন করা হয়েছে লোকালয় তথা মানুষের বসতবাড়ি, গ্রাম-গঞ্জ, শহর বন্দরের অতিসন্নিকটে, কৃষি জমিতে, নদীর তীরে, পাহাড়ের পাদদেশে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে। ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ইটভাটা সৃষ্ট দূষণে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, এলার্জি, শ্বাসকষ্ট ও ঠা-াজনিত নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। ইটভাটার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ছাই, ধুলা ও সালফার-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস। আক্রান্ত এলাকায় ধাতব পদার্থে মরচে সৃষ্টি, বর্ণক্ষয়, ভূমিক্ষয়, ভূমিধস ও ভূমির উর্বরতা হ্রাস এসিড বৃষ্টির মতো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইটভাটাসৃষ্ট দূষণ পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি উৎপাদন ও ফল-মূলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত এবং গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। এতদসত্ত্বেও বিশ্বায়নের এই যুগে ইটের চাহিদাকে সামনে রেখে বিভিন্ন দেশে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইট তৈরী করা হচ্ছে। গত ২০০১ সাল থেকে ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও তা অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। ইটভাটা থেকে দূষণ কমানোর লক্ষ্যে পুরনো পদ্ধতির ইটভাটার পরিবর্তে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও আধুনিক প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপনের লক্ষ্যে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনটি গত ০১ জুলাই ২০১৪ খ্রিঃ তারিখ হতে কার্যকর হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×