ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ও আলোর পথযাত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৪ আগস্ট ২০১৮

 ও আলোর পথযাত্রী

এই জাতির জন্য, এ দেশের শিক্ষিত মানুষের জন্য, বিত্তবান মানুষ এবং সমাজ গঠনে দায়বদ্ধ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য এর চাইতে অধিকতর আত্মপীড়নের বিষয় আর কি হতে পারে? আমাদের দেশের নতুন প্রজম্নের শিশু-কিশোররা গত পাঁচ দিনে রাস্তায় নেমে আমাদের সবার দিকে আঙুল তুলে বলে দিয়েছে : ‘তোমরা পার না কিছুই, সামলাতে পার না দুর্বৃত্তদের, ঘাতকদের, লোভী এবং মনুষ্যত্ববর্জিত নেশাগ্রস্ত উমাদদের। ওরা নির্বিচারে অন্যায় করে যাবে, অপরাধ করে যাবে আর তোমরা হয় তাদের সহ্য করবে মুখবুজে অথবা গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেবে নিজেদের। অর্থহীন ভয় ছড়িয়ে তোমরা আটকে রাখবে আমাদের, মুখ খুলতে দেবে না, প্রতিবাদ করতে দেবে না এটা আর হবে না। তোমরা দেখ, আমরা পারি, আমরাই পারি ঘাতকদের ঘাতক বলতে, অন্যায় এবং অপরাধকে অন্যায় এবং অপরাধ বলতে। আমরা রাস্তায় নেমে বেআইনী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছি তোমরা তো পারনি। তোমরা তো পারনি মন্ত্রীদের গাড়ি ভুল পথে গেলে আটকে দিতে। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি নিয়ে পুলিশ সদর্পে রাস্তা দাপালে আমরা আটকে দিতে পারি তাদের। আমরা আরও অনেক কিছু পারি যা তোমরা পার না, পারনি। ‘আমরা পেরেছি একজন প্রতিপত্তিশালী মন্ত্রীকে খুনী বাসের চাকায় প্রাণ হারানো কিশোরী দিয়ার বাড়িতে গিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করাতে, তাঁকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে সকল শিক্ষার্থীর কাছে ক্ষমা চাওয়াতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও কোন আমলে কোন মন্ত্রী তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এমন নজির নেই। আমরাই সেটা সম্ভব করেছি। আমরা পেরেছি দায়িত্বশীল অন্যান্য মন্ত্রীকে আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করাতে। আমরা প্রমাণ করেছি শোককে কীভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। ‘আমরা ফিরে যাব আমাদের শ্রেণীকক্ষে, ফিরে যাব নিজেদের ঘরে, আমরা দিয়াকে, করিমকে ভুলব না কখনও। কারণ তারাই আমাদের আত্মশক্তি বিকাশের উৎস। কিন্তু আমরা একইসঙ্গে সতর্ক, আমাদের প্রিয় দুই সাথীকে যেন কোন মহল কোন বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে। আমরা পথে নেমেছি শুধু একটি নষ্ট প্রক্রিয়া যেভাবে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা, জীবন বিপর্যস্ত করে চলেছে; অন্যায়, অবিচার এবং দুর্নীতি আমাদের মেরুদ-কে ক্রমাগত ক্ষয় করে চলেছে, আমরা পথে নেমেছি সেটাই রুখে দিতে। আমরা চাই একটি সুস্থ সমাজ নির্মাণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত গর্বিত জাতির উত্তরাধিকার হতে। জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে যারা সঙ্কীর্ণ ক্ষুদ্র স্বার্থে, ভোগবাদী লালসায় বারংবার ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে, সেই অশুভ পন্থার স্বরূপ তুলে ধরতেই আমরা পথে নেমেছি। ন্যায় এবং সত্য আমাদের লক্ষ্য, ঐক্যবদ্ধ সৎ উদ্যোগ আমাদের শক্তি। ‘আমাদের তো এভাবে পথে দাঁড়ানোর কথা ছিল না, আমাদের তো কাজ নয় রাস্তায় ত্রুটিপূর্ণ যান চিহ্নিত করা, আমরা তো মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য পথে নামিনি। আমরা চেয়েছি মানুষের চলার পথ সুস্থ, স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ হোক। কেন এই কাজগুলো আমাদের করতে হচ্ছে যে কাজ বড়দের করার কথা, দায়িত্বশীল মহলের করার কথা, যে কাজ গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের করার কথা।’ বিজ্ঞ পাঠক, তীব্র বেদনা, ক্ষোভ এবং অসহায়ত্বের বোধ থেকে আজ আমি কলম হাতে নিয়েছি। আমরা যদি মনে করে থাকি আমরা যা খুশি করে যাব আর নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোররা তাই-ই মেনে নেবে, ফার্মের মুরগির মতো জালের বেষ্টনীর ভেতর হৃষ্টপুষ্ট হতে থাকবে, তাহলে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল। আমাদের একুশের ঐতিহ্য যেমন সেই আটচল্লিশ কিংবা বায়ান্ন সালে গতানুগতিকতার প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন আমাদের শিখিয়েছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে নতুন সমাজ কাঠামো নির্মাণের জন্য আপোসহীন হতে ঠিক সেই একইভাবে, সেই একই দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে নতুন প্রজন্ম এই বিপন্ন ব্যবস্থাকে সংশোধন করার জন্য ধনুর্ভাঙা পণ করেই পথে নেমেছে পূর্বসূরিদের জড়তা, দুর্বলতা, ব্যর্থতার পাদপীঠে নতুনের কেতন উড়িয়েছে। কত কী যে শেখার আছে এদের কাছে! কিভাবে মানুষের ভালবাসা আদায় করতে হয়, কিভাবে অর্জন করতে হয় সমর্থন তা তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সবাইকে। লাইসেন্স না থাকলে রেহাই দিচ্ছে না পুলিশের গাড়িকেও, সার্জেন্টকে দিয়ে তাঁর নিজের বিরুদ্ধেও মামলা করতে বাধ্য করছে, যে গাড়ির কিংবা চালকের কাগজপত্র সঠিক আছে, তাঁকে আপ্যায়ন করছে, যে পুলিশ কিংবা সার্জেন্ট ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের অভিনন্দিত করেছে তারা কখনও করতালি দিয়ে, আবার কখনও পুষ্পশুভেচ্ছা দিয়ে। আরও কী করছে তারা? হজযাত্রী কিংবা পথচারীদের নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে। কোন কোন অনুপ্রবেশকারী দুর্বৃত্ত কোথাও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে তারা তাদের নিবৃত্ত করছে। রাস্তার মধ্যে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা কাঁচের গুঁড়া ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছে। ভাঙা রাস্তা যাতে যান চলাচলের উপযোগী হয় সেজন্য তারা রাস্তায় বিছিয়ে দিচ্ছে ইটের খোয়া। না দেখলে এটা বিশ্বাস করা যায় না। উদ্যোক্তাদের কারও কারও সঙ্গে রাজপথেই আমার কথা হয়েছে। বিনীত, নম্র, সৌজন্যবোধসম্পন্ন ঐ তরুণ এবং যুবকদের আচরণে সামান্যতম উগ্রতা নেই। অত্যন্ত শান্ত, স্থিরভাবে পরিশ্রান্ত শরীরে সামলাচ্ছে সবদিক। তাদের নেতৃস্থানীয় একজনকে বলেছি কোথায় যতি দেবে, কোথায় বিরতি সবকিছু ভেবেই পা ফেলতে হয়। যারা পথে নেমেছে, তাদের সংখ্যা যত বাড়বে দায়িত্ব এবং ঝুঁকিও ততটাই বাড়বে। চিন্তা করতে হবে কতদূর যাবে, কোথায় গিয়ে থামবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত রাতে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে সরকারের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। নয় দফা দাবি তার যৌক্তিক সফলতা অর্জন করেছে। দিয়ার পিতা এবং রাজুর বিধবা মাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডেকে নিয়ে সান্ত¡না দিয়েছেন, তাৎক্ষণিক কিছু অর্থসাহায্য করেছেন। দিয়ার পিতা বলেছেন, সবাইকে তাদের শ্রেণীকক্ষে ফেরত যেতে এবং কোন মহলের কোন উস্কানিমূলক কার্যক্রমে বিপর্যস্ত না হতে। ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে বসে মনে হলো দুই মনীষীর দুই অমর বাণী। কবি আলেকজান্ডার পোপ তাঁর কবিতার একাংশে বলেছিলেন : We think our fathers are fools So wise we grow; Our wiser sons no doubt will think us so… আর কাহ্লিল জিবরানের ভাষায় : “Our children. Our children who are unique, individual human beings, with whom we are only together for a spell. Our children who will help move the wheel of humanity a fwe feet farther than well be able to see. Our children who have their own desti and their own purpose separate and apart from our own.” এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে আমাদের। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্বসূরির আশীর্বাদ, আমরা তোমাদের ওপর বিশ্বাস রাখি। মনে রেখ সেই-ই সফল সংগ্রামী যে জানে কতদূর যাওয়া উচিত হবে এবং কোথায় থামতে হবে। লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ
×