ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষতিপূরণ মিলছে না ॥ সৌদিতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, বছরের পর বছর দুর্ভোগ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৪ আগস্ট ২০১৮

  ক্ষতিপূরণ মিলছে না ॥ সৌদিতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, বছরের পর বছর দুর্ভোগ ক্ষতিগ্রস্ত  পরিবারের

আজাদ সুলায়মান ॥ বছরচারেক আগে সৌদি আরবের রিয়াদের শিফা সানাইযায় ‘তিতাস ফার্নিচার’ নামের সোফা তৈরির একটি কারখানায় অগ্নিকান্ড ঘটে। তাতে ৯ বাংলাদেশী শ্রমিক পুড়ে মারা যান। ওই ঘটনায় তোলপাড় হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সবাই আজও প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি। নয়জনের মধ্যে ৬ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেও বাকি ৩ জনের পরিবার আজও কিছুই পাননি। বলা হচ্ছে- তারা তিনজনই অবৈধভাবে সেদেশে ছিলেন। ২০১৪ সালের ১২ মে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত তিনজন গাফফার,নাজির ওরফে মিজান এবং বাহাউদ্দিনের বৈধ কাগজপত্র না পাওয়ার কারণে লাশ পাঠাতেও অনেক বিল¤ব হয়েছিল। পুড়ে মারা যাবার ১৭ দিন পর সৌদি আরব থেকে আনা হয়েছিল তাদের লাশ। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড সূত্র জানায় নিহত অন্য ছয় জন হলেন কুমিল্লার হোমনা উপজেলার চাঁদেরচর গ্রামের সেলিম, কলাগাছিয়া গ্রামের মতিউর রহমান, তিতাস উপজেলার দুলারমপুর গ্রামের জালাল, একই উপজেলার কালিপুর গ্রামের শাহ আলম, ফেনীর জাকির হোসেন ও মাদারীপুরের মোঃ আক্কাস। তাদের মরদেহ ঢাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে দেয়া হয় এককালীন ৩৫ হাজার টাকা। পরের ধাপে দেয়া হয় আরও ৩ লাখ করে। কিন্তু তারা সৌদি আরবের যে কোম্পানির অবহেলায় অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন সেই কোম্পানির তরফ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আজও পাননি। যৎসামান্য কিছু টাকা তাদের হাতে ধরিয়েই দায় সারে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এদের মতো এমন অসংখ্য সৌদি প্রবাসী প্রাণ হারালেও ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড অফিসে গেলে প্রতিদিনই এমন অসংখ্য ভিকটিমের পরিবারের দেখা মিলে যারা বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিপূরণের জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন। এখানকার জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল আনোয়ারের ভাষ্যমতে ‘শুধু এক-দুই বছর নয়, ৭/৮ বছর ধরেও ক্ষতিপূরণের জন্য অনেককে এই অফিসে তদ্বির করতে দেখা যায়।’ তিনি জানান, প্রতিমাসেই গড়ে সৌদি আরব থেকে অর্ধশত মরদেহ আসছে। অন্যান্য দেশ মিলিয়ে এ সংখ্যাটা মাসিক হারে বলা যায় কমপক্ষে শ’ তিনেক। তারা সৌদি আরবের ক্ষতিপূরণের টাকা না পেলেও ঢাকায় আসার পর প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের কাছে পাওনা সবটাই পাচ্ছেন। জানা গেছে, গত দুই মাসেই সৌদি আরবের বিভিন্ন প্রদেশে কমপক্ষে শতাধিক প্রবাসী শ্রমিক কর্মস্থলে ও ঘরে ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। মরদেহ এলেও তাদের পরিবার কবে নাগাদ মূল ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন তা অনিশ্চিত। সর্বশেষ গত জুনের শেষ সপ্তাহে ওমরাহ শেষে মদিনা থেকে জেদ্দায় ফেরার সময় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকার জুলহাসসহ ৫জন প্রাণ হারান। আহত হন ৪ জন। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি উল্টে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। তাদেরকে ওই দেশেই দাফন করা হয়। তাদের পরিবার এখনও সেই ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। সৌদিতে এ নিয়ে চলছে মামলা। সেখানকার আদালতে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে কার দোষে এ দুর্ঘটনা। যদি চালকের ভুলে এটি হয়ে থাকে তাহলে গাড়ির মালিককে এ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি যাত্রীর কোন ভুলত্রুটির দরুন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে ক্ষতিপূরণ পাবে যৎসামান্য। যদি অন্য কোন গাড়ির ভুলে দুর্ঘটনা হয় তাহলে ওই গাড়ির কোম্পানিকে দায় নিতে হবে। এটাই সৌদির শরীয়াহ আইন। এতে প্রবাসী শ্রমিকদের পাওনার অধিকার যথেষ্ট নিশ্চিত করা হয়েছে বলে মনে করেন সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী মইন সুলতান। তিনি বলেন, যে যাই বলুক সৌদি সরকার এসব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারই করে। পারতপক্ষে ভিকটিমকে ঠকায় না। এ সুনাম আছে তাদের। ২৮ জুলাই সৌদি আরবে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নুুুরুল ইসলাম বাদশা (৩৫) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও চারজন। রাত ১১টার দিকে সৌদির জিজান জেলার দারব এলাকার পতেহা সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত নুরুল ইসলাম বাদশা কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিয়াপাড়ার মধু মাঝির বাড়ির আবু তাহেরের ছেলে। আহতরা হলেন- পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া এলাকার মোঃ নুরুন্নবী (২৭), মিয়াপাড়ার আসাদু মিয়া (২৩), মোঃ ছোটন (২৫) ও কক্সবাজার সদর উপজেলার মোঃ আব্দুল্লাহ (২৪)। ক্ষতিপূরণ পেতে হলে সৌদির আদালতে মামলা-মোকদ্দমার আশ্রয় নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। ভিকটিম ক্ষতিপূরণ না নিতে চাইলেও সেখানকার আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা চালাবে, বিচারকাজ করবে। কার কতটুকু দোষত্রুটি আছে সবই চিহ্নিত করা হবে। জানা যায়, সৌদিতে ঘটনা-দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ফয়সালা হয় সেখানকার আদালতে। কোন দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক টহল পুলিশ এসে লাশ উদ্ধারের পর থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের পর আদালতে মামলার রায় হয়। মামলার যুিক্ততর্কে প্রকৃত ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার ওপর নির্ভর করে ভিকটিমের পরিবার কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবে। রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ওপর যদি কেউ দৌড়ে এসে নিচে পড়ে মারা যায় কিংবা আহত হয় তাহলে এর ক্ষতিপূরণ খুব কম। আবার যদি নিরাপদে দাঁড়িয়ে থেকেও কিংবা যানবাহনে চলার সময় অন্য গাড়ি বেআইনীভাবে বা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে তাহলে তার ক্ষতিপূরণ সবটাই দিতে হবে ওই গাড়ির মালিক বা কোম্পানিকে। এ বিষয়ে দীর্ঘদিনের সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মইন উদ্দিন আহমেদ সুলতান বলেন, সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা কারখানায় কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার প্রতিটি শ্রমিক বা নাগরিককে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গড়পড়তায় নিহতের পরিবার কমপক্ষে ১ লাখ সৌদি রিয়াল ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন। এটা সৌদি সরকার নিজের তাগিদেই করে থাকে। এ হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে এদিক থেকে সৌদি আরবের প্রদত্ত সুবিধাদি অনেক ভাল। হতাহতরা কখনই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয় না। এ বিষয়ে ওয়েজ আনার্স ওয়েলফার বোর্ডের সহকারী পরিচালক মোঃ জাহিদ আনোয়ার জনকণ্ঠকে বলেন- প্রত্যেক মাসে গড়ে কমপক্ষে ৩শ’ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিক বিভিন্নভাবে প্রাণ হারান। এর মধ্যে সৌদি আরবেই বেশি। প্রতিমাসেই গড়ে অর্ধশত সৌদি প্রবাসী বিভিন্নভাবে নিহত হন। বেশিরভাগই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। তাদের ক্ষতিপূরণও দেয়া হচ্ছে বেশ ভালই। তিনি বলেন, সৌদিতে কোন সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সেখানকার আদালতে বিচার চলে। সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার উইংয়ের পক্ষ থেকে আইনজীবী বা সলিসিটর নিয়োগ দেয়া হয়। তারাই আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে ভিকটিমের পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণের টাকা পৌঁছে দেন। জাহিদ আনোয়ার বলেন, সেই টাকা ভিকটিমের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ারও একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে উত্তরাধিকার সনদ (সাকসেশন সার্টিফিকেট) নিয়ে যাকে পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দেয়া হবে তিনিই এ টাকা নিতে আসেন প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডে। এখান থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে চেকের মাধ্যমে ওই টাকা প্রদান করা হয়। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, সৌদিতে মামলার রায়ে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ থাকার পরও অনেকেই বছরের পর বছর ধরে তা পাচ্ছেন না। কিশোরগঞ্জের নুরুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক জানান, তার মেয়ের জামাই মারা যাওয়ার একযুগ পরও আজও সেই ক্ষতিপূরণের সব টাকা তিনি পাননি। বার বার তাকে কাকরাইলের জনশক্তি অফিসে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। নুুরুল ইসলামের মতো শেরপুরের মাহবুব, নরসিংদীর মান্নানেরও একই অভিযোগ। তারা জানিয়েছেন, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের টাকাটা পেলেও সৌদি কোম্পানির টাকা আজও মেলেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের সাবেক এক পরিচালক বলেন, একেক দেশে নিহত হওয়ার ক্ষতিপূরণ একেক ধরনের। সৌদিতে একজন শ্রমিক কর্মস্থলে মারা গেলে তার পরিবার ক্ষেত্র বিশেষে ১ লাখ রিয়াল পর্যন্ত পেতে পারেন। কুয়েতে অবশ্য আরও বেশি। সর্বোচ্চ ২৭ লাখ পর্যন্ত। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরও কম। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরেও খুব একটা বেশি দেয়া হয় না। সে তুলনায় সৌদি আরবে হতাহতরাই তুলনামূলক বেশি ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকে। তিনি বলেন, আইন হচ্ছে যেই কোম্পানিতে কাজ করার সময় বা অন ডিউটিতে থাকার সময় কোন শ্রমিকের প্রাণহাি ঘটলে ওই কোম্পানিকেই সব দায় নিতে হবে। কিন্তু অধিকংাংশ ক্ষেত্রেই এ আইন মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানেরও দায় রয়েছে। এ বিষয়ে ওয়েজ আনার্স ওয়েলফার বোর্ডের সহকারী পরিচালক মোঃ জাহিদ আনোয়ার বলেন, প্রবাসে নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রক্রিয়াটি দিন দিনই বেশ সহজ করা হচ্ছে। এক সময় এজন্য অনেক বেগ পেতে হতো। সময় লাগত। এখন সেই অবস্থা নেই্। প্রবাস থেকে লাশ আনার সময় বিমানবন্দরেই ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয় মরদেহ দাফন-কাফনের জন্য। তারপর কল্যাণ ভাতার টাকা। পাশপাশি সৌদি সরকার বা কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত টাকাও দেয়া হয় যথেষ্ট স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। তারপরও মাঝে মাঝে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কথা জানা যায়। যেমন বছর কয়েক আগে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে এসে কল্যাণ বোর্ড অফিসেই নিহত ব্য্িক্তর স্বজনদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। নিহতের নিজ পরিবার ও শ্বশুর পরিবারের মধ্যে তুমুল বাগবিত-া হয়। শেষ পর্যন্ত যেই পক্ষ পেশীশক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে সেই পক্ষকেই দেয়া হয়েছে চেক।
×