ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ৩ আগস্ট ২০১৮

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নারী

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন পৈত্রিক জমিদারি তদারকি করতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরে। ঘুরে বেড়ান জমিদারি দেখার সুবাদে নিভৃত পল্লীর নির্জন পরিবেশে, নদীবিধৌত বাংলার প্রমত্ত পদ্মায় বজরা ভ্রমণের মধ্যে বেরিয়ে আসেন ‘সোনার তরী’র মতো কাব্য সম্ভার। শুধু তাই নয় দরিদ্র, নিপীড়িত প্রজাকুলের সঙ্গে গড়ে ওঠে অকৃত্রিম যোগাযোগ, তৈরি হয় ব্যাপক গণসংযোগ। গ্রামের জনপদ ও গোষ্ঠীর সঙ্গে অবাধ মেলামেশা এবং অদ্ভুত সৃজনশীলতায় বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তৈরি হয় এক শুভ যোগ। বাংলা সাহিত্য পায় এক নতুন ধারা যার সূচনা এবং বিকাশে কবির ভূমিকা যুগান্তকারী। শুধু তাই নয় অবহেলিত গ্রামবাংলার নির্মল নৈসর্গিক বৈভবে কবি নিজে যেভাবে পরিতৃপ্ত আর পূর্ণ হয়েছেন একইভাবে ছোটগল্পের সমৃদ্ধ বলয়কেও ভরিয়ে তুলেছেন। সাহিত্যের এই বিশেষ ধারার সফল অধিনায়ক যেমন তিনি সেভাবে সেখানে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং বিশ শতকের প্রথম দশক মূলত ছোটগল্পের শুভযাত্রা এবং বিকাশ। যদিও জীবনের শেষ সময়েও অস্তগামী রবির কিরণছটা পড়ে ছোট গল্পের এই ধারায়। ভাবুক, চিন্তাশীল, আবেগপ্রবণ রবীন্দ্রনাথ সমাজ বাস্তবতার মূল শেকড় থেকে তুলে আনেন তাঁর ছোটগল্পের বহুমাত্রিক উপাদান। শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার জোয়ার তখনও বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়ায়নি। ফলে তাঁর ছোটগল্পের সিংহভাগ জুড়ে থাকে অবহেলিত গ্রাম, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। সমাজের গভীরে লালন করা নানাবিধ সংস্কার, গতানুগতিক মূল্যবোধ, চিরায়ত ঐতিহ্যিক ধারা পশ্চাদপদ এই জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। নবজাগরণের মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্ধাংশ নারী জাতির সামাজিক অবস্থানও উঠে আসে কবির সৃজন দ্যোতনায়। আধুনিকতার নব্য সংস্কৃতির যুগের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া নারীরা যে কত অসহায়, বিপন্ন এবং শোচনীয় অবস্থায় পতিত তা রবীন্দ্রনাথে শৈল্পিক আঁচড়ে তীব্রভাবে দৃশ্যমান। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃসহ জীবনের মর্মকথা গল্পের উপজীব্য করতে গিয়ে নারী চরিত্রের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তৎকালীন সমাজের নির্মম বাস্তবতা। নারীদের কঠিন জীবনের রূঢ় সত্যকে ছোটগল্পে ধারণ করে তিনি যে সমাজ বাস্তবতাকে মূর্ত করেন সমকালে নারীর অবস্থা আসলেই তাই ছিল। প্রথম সার্থক ছোটগল্প ‘দেনা-পাওনা’য় পণপ্রথার আবর্তে বলি হওয়া নিরুপমার বিবাহিত জীবনের যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তা আজও গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিষ্ঠুর অবয়ব। এর সঙ্গে নির্বিত্ত পিতারাও হয় নিপীড়নের শিকার। ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পে রতনের বিপন্ন সামাজিক অবস্থা তার স্বপ্ন আর আশা- আকাক্সক্ষার প্রতিকূলে ছিল। ফলে রতনের পরিণতি ছিল দুঃসহ জীবনের ঘানি টানা। ‘কঙ্কাল’ গল্পটি নারী নিগ্রহের অতি সাধারণ ঘটনা। সেই বাল্য বিবাহ আর অকাল বৈধব্য। সমাজ ব্যবস্থার এক নিষ্ঠুরতম বিধি। যা কোন মেয়েকে স্বাভাবিক স্বপ্ন দেখা থেকে দূরে রাখে। সমস্ত চাওয়া-পাওয়া অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। এমনকি আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া পথও থাকে না। ‘ত্যাগ’ গল্পটি কুসুম এবং হেমন্তের বিবাহিত জীবনের সুখ ও দুঃখের এক অবিমিশ্র কাহিনী। সেই জাত, ধর্ম এবং কৌলিন্যের প্রাচীনতম সংস্কার। কিন্তু নায়ক সেই অভেদ্য বেড়াজাল থেকে বের হয়ে এসে পিতাকে ত্যাগ করে, স্ত্রীকে নয়। যুগের অগ্রগামী চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ এখানে আধুনিকতার দিশারী। ১৮৯২ সালে লেখা এই গল্পটি তৎকালীন বিভেদপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবল এবং সক্রিয় প্রতিবাদ। জীবিত ও মৃত গল্পটি নারী নির্যাতনের ভিন্ন মাত্রার রূপ কল্পনা। বিধবা এবং নিঃসন্তান নারী অসহায়ভাবে বেঁচে থাকায়ই শুধু নয় নির্মম পরিণতিতে মরণকে বরণ করে জীবিত থাকার প্রমাণ দেয়াও। ‘সুভা’ গল্পটি মানসিক ভারসাম্যহীন সাধারণ মেয়ের বেদনাক্লিষ্ট জীবন গাঁথা। নির্বাক মেয়েটিকে বিয়ে দিতে দরিদ্র পিতার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিয়ে যদিওবা হয় সংসার টেকে না। ‘মহামায়া’ গল্পটি ভিন্ন আঙ্গিকে নারীর বিপন্ন অবস্থায় নেমে আসা ঝড় ঝাপটার করুণ চিত্র। বংশ মর্যাদা ও কৌলিন্যের দাপটে মহামায়ার কাছের মানুষ নিজের হয় না। মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে, সহমরণে যাওয়া এবং জ্বলন্ত চিতা উঠে আসা। পরবর্তীতে মনের মানুষের আস্তানায় ফিরে গেলেও পরিণতি সুখকর হয়নি। কারণ সে আশ্রয় থেকেও একসময় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মহামায়া। কঠিন সমাজের নির্মম ¯্রােত নারীকে তার আকাক্সিক্ষত গন্তব্যে কোনভাবেই পৌঁছাতে দেয় না। ‘শাস্তি’ গল্পটি বিধিবদ্ধ পুরুষ শাসিত সমাজের এক নিষ্ঠুরতম আলেখ্য। এখানে গল্পের দুই নারী একজন খুন হয় অন্য জন মিথ্যা অপবাদের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে খুনের আসামি। পুরুষের নির্মম আধিপত্যের ছায়ায় নারী শক্তির যে বলিষ্ঠতা নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার যে অনমনীয় দৃঢ়তা তাতে নারী ব্যক্তিত্বের জেদ ও তেজের কাছে পরাক্রমশালী পুরুষের অবধারিত পরাজয়ে কবি মানুষ আর ব্যক্তিক মহিমারই জয়গান গেয়েছেন। সমাজ বাস্তবতার মৃল অবয়বকে উন্মোচিত করতে গিয়ে কবি নারী স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রতিও তাঁর সহৃদয় নজর দিতে কার্পণ্য করেননি। ‘শাস্তি’ গল্পটি সে ধারারই সফল সংযোজন। তার ছোটগল্পে শুধু নারীরাই নয় হতদরিদ্র, অসহায়, নির্বিত্ত পুরুষরাও তাদের সামাজিক অবস্থানে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে ছোটগল্পের সিংহভাগ নারী চিত্রিত হয় সনাতনী ধারায়। আধুনিক চেতনাসম্পন্ন নারীর সংখ্যা হাতেগোনার মতো। নতুন-পুরনোর শক্তি সংহত করেন কয়েকটি নারী চরিত্রে। তবে প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রে যেটা সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে তাঁর গল্পে মূর্ত হয় সেটা শুভ আর লাবণ্যের মিলিত রূপশৌর্যে। নারীর যে মাঙ্গলিক মাধুর্য সেটা তাঁর সাহিত্যজুড়েই দীপ্যমান। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×