ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র প্রয়াণ স্মরণে

চার অধ্যায়ের এলা

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ৩ আগস্ট ২০১৮

চার অধ্যায়ের এলা

নাজনীন বেগম উনিশ শতকে সাহিত্যের অঙ্গনে উপন্যাসের বলয় বঙ্কিমচন্দ্রের একচ্ছত্র আধিপত্যে পরিপুষ্ট, আলোচিত এবং প্রভাবিত। বিদ্যাসাগরে নারী বিষয়ক বহুবিধ কর্মযোগ বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়া, নারী শিক্ষা অবারিত গতি পাওয়া, বাল্যবিবাহ রোধ তৎকালীন বাঙালী সমাজকে নতুন আলোর পথ দেখায়। ইউরোপীয় শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতার প্রভাব বাঙালীর মন ও মননে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। জ্ঞানী-গুণীর মহাসম্মিলনে ঠাকুর বাড়ির সমৃদ্ধ পরিবেশ বঙ্গীয় রেনেসাঁসের আর এক সফল সংযোজন। এসব মিলিয়ে রবীন্দ্রচেতনায় যে উপনাস ভাবনা তা সঙ্গত কারণে উনিশ শতকের সমাজ ব্যবস্থার এক বাস্তব প্রতিফলন। আর বিশ শতকীয় উত্তাল সামাজিক প্রতিবেশ কবিকে ভিন্নমাত্রার আদর্শিক চেতনার অনুষঙ্গ করে তোলে। সেখানে আধুনিকতার জয়মাল্য, বিশ্ব পরিসরের সময়ের আবেদন আরও তীব্রভাবে আপন সমাজ-সংস্কারের বেড়াজাল কবিকে যে মানসিক লড়াইয়ের মুখোমুখি করে অনিবার্যভাবে তার প্রভাব পড়ে তার সৃজন ক্ষমতায় এমনকি যুক্তিশীল মননেও। নারী ভাবনায়ও আসে সুদূরপ্রসারী সচেতন প্রত্যয়। নারীকে যথাযর্থ মানুষ ভাবার দৃপ্ত অঙ্গীকারে আধুনিক মনন, যুগের দাবিই শুধু নয় স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে নারীর সঙ্কল্পবদ্ধ চেতনাও কবিকে নানা মাত্রিকে তাড়িত করে। সময়ের দুর্বার মিছিলে তার আদর্শিক বোধও সব সময় এক জায়গায় স্থির থাকেনি। নারীর ক্ষেত্রে হয়েছে তা অনেকখানি বিবর্তনমূলক। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক শক্তির প্রতি নিবেদিত কবি নতুন সময়ের একজন বলিষ্ঠ নায়কও বটে। ফলে তাঁর সৃজনশীল দ্যোতনা বিশেষ করে ছোটগল্প, উপন্যাস এবং নাটকে নারী ভাবনায় যে পরিবর্তিত ধারা সেটা ধরতে পারলে বোঝা যায় চিরায়ত শুদ্ধ প্রতিমার রূপ আঁকতে গিয়ে নতুন সময়ে তাদের অধিকার, স্বাধীনতাকেও সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন। নারীর আশা-আকাক্সক্ষা, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরোধকে কখনও অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করেননি। বিশেষ করে উপন্যাস ভাবনার কবির নারীর প্রতি দায়বদ্ধতা অত্যন্ত প্রখর ছিল। উপন্যাস লিখেছেন কম মাত্র ১৪টি। বেশ কয়েকটি উপন্যাস সাড়াও জাগিয়েছে। ‘চোখের বালি’র ভিন্ন মাত্রার আবেদনে সমকালে এই উপন্যাসকে সংশ্লিষ্ট অঙ্গনের মোড় পরিবর্তন হিসেবেও বিবেচনায় আনা হয়। আর ‘গোরা’ তো সর্বভারতীয় আধ্যাত্মচেতনার এক মহাকাব্যিক আলেখ্য। যেখানে নারী চরিত্রগুলো সময়ের যৌক্তিক আহ্বানকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানাচ্ছে। আর ‘চতুরঙ্গে’র দামিনী তো প্রথাসিদ্ধ সমাজের বিপরীতে এক প্রচ- ঝড়ো হাওয়া। আর তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস চার অধ্যায়ের এলা সময়ের উত্তাল আবহে বিক্ষিপ্ত ঝড় ঝঞ্ঝায় নিজেকে জড়িয়ে নেয়া এক বিপ্লবী নারী সত্তা। যে কিনা আধুনিক সময়ের বলিষ্ঠ পথিকই শুধু নয় মানুষ হিসেবে সব ধরনের অধিকার আর প্রাপ্তি নিজের আয়ত্তে এনে পূর্ণাঙ্গ সত্তায় আপন মর্যাদাকে জোরালো করে। ১৯৩৪ সালে কবির এই বিখ্যাত উপন্যাস ‘চার অধ্যায় কোন পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ না হয়ে একেবারে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। ১৯৩০-এর দশক। বাংলাসহ অবিভক্ত ভারত উত্তাল, হিংসায় উন্মত্ত এবং রক্তক্ষয়ী জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। সমাজ সংস্কৃতিতে যেমন তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব একইভাবে সৃষ্টিশীল মানুষরাই হয়ে ওঠেন বাক্সময়, প্রতিবাদমুখর এবং উদ্ভূত সঙ্কট থেকে উত্তরণের নতুন পথের দিশারী। এই অপ্রতিরোধ্য, দুর্বার সাংঘর্ষিক কর্মযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে করে শঙ্কিত, উদ্বেলিত এবং অনেক বেশি যুগ সচেতন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন সূক্ষ্ম দ্রষ্টা। এর আগে স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। সন্দীপের উদ্দেশ্যহীন দেশাত্মবোধের কৃত্রিম আবরণ এবং বিমলার বিপর্যস্ত আত্মগ্লানির শোচনীয় পরিণতিতে। সন্দীপের প্ররোচনায় বিমলার আবেগতাড়িত দেশপ্রেম, অন্তর থেকে গড়ে ওঠা মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের কোন আদর্শিক বোধ ছিল না। ফলে না সন্দীপ না বিমলা কেউই সেভাবে সত্যিকারের বিপ্লবীর আসনে বসতে পারেনি। কিন্তু চার অধ্যায়ের এলা, অতীন কিংবা ইন্দ্রনীল এরা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বিপ্লবী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত, দীক্ষিত এবং সক্রিয়ভাবে সংঘাতপূর্ণ কর্মকা-ে উৎসর্গীকৃতও। এলা তো অতি বাল্যকাল থেকে গড়ে ওঠা প্রচলিত সংস্কারবিরোধী এক বিপ্লবী নারী সত্তা। তাই শুধু স্বদেশ ভাবনায়ই, নারীর অবস্থান নির্ণয়েও ‘চার অধ্যায়’ ব্যতিক্রমী এক উপন্যাস। মাতৃভূমির প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা কবির বরাবরই ছিল। সৃজন এবং মনন উভয় আঙিনায় এখানে কোন আপোসকামিতা কখনও চলেনি। স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল স্রোত তাঁকে কখনও এর পক্ষে যেতে দেয়নি। বরং সাংঘর্ষিক রক্তক্ষয়ী অভিযান তাকে আহত করেছে। শেষ অবধি মানতেও পারেননি রক্তাক্ত ধারায় এসব অনাকাক্সিক্ষত বিপ্লবী কর্মপ্রক্রিয়া। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ কিছু দামাল ছেলে আত্মঘাতী যে হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে সেটাও তাকে বিমর্ষ করে, কষ্ট দেয়। এই দুর্দমনীয় উন্মত্ততায় তিনি চিন্তিত হন, বিব্রতবোধ করেন, আন্দোলনের প্রতি অনাসক্তি জন্মায়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এসব বেপরোয়া, উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজের মর্মান্তিক ও ভয়ানক আকাক্সক্ষা এবং পরিণতিতে তিনি শঙ্কিত হন। ‘ঘরে বাইরে’ সন্দীপ চরিত্রে তা প্রকটভাবে স্পষ্ট এবং বিমলার অযৌক্তিক পথচলায় তাঁর সৃষ্টিশীল বোধতাড়িত হয়, অশুভ পরিণতির আশঙ্কায় ঐতিহ্যিক সংস্কারকে দৃঢ়ভাবে সংহত করেন। কিন্তু এলার বেলায় তা হয়নি। নিবেদিত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এলা যথার্থ বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ করেও পরিণতি শুভকর হয়নি। যে কণ্টকাকীর্ণ সম্মুখ সময়ে এলা এবং তার সহযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার অনিবার্য পরিণতি শান্তি, মঙ্গল কিংবা সুষ্ঠু পরিণাম দেখানো যায়নি। এখানে লক্ষণীয় এলা, অতীন কিংবা ইন্দ্রনীল নারী কিংবা পুরুষ নয়। তারা সবাই শুধুই বিপ্লবী আর মানুষ। চার অধ্যায় এলাকে কেবল নারী নয় মানুষ হিসেবে সব ধরনের অধিকার এবং স্বাধীনতা অর্পণ করা হয়। তাই এলা ভাবতে পারে বিয়ে কিংবা সংসার নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়েও মানুষের জীবন চলা সম্ভব। ইন্দ্রনীল এবং অতীনের মতো স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামে নিজেকে নিবেদনেও সঙ্কল্পবদ্ধ হয়। আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক এলাকে নিয়ে সমালোচনারও ঝড় ওঠে। যে সমৃদ্ধ চেতনা নিয়ে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন সেই আন্তরিক বোধ থেকে উত্তর দেন এসব প্রতিবাদের। ‘যেটাকে এই গল্পের আখ্যানবস্তু বলা যেতে পারে সেটা হলো এলা ও অতীনের ভালবাসা, এলা ও অতীনের ভালবাসার সেই বৈশিষ্ট্য এই গল্পে মূর্তিমান করতে চেয়েছি। তাদের স্বভাবের মূলধনটাও দেখতে হয়েছে। সেই সঙ্গেই দেখাতে হয়েছে যে অবস্থার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কারবার করতে হলো তারও বিবরণ।’ এই চরম রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে গিয়ে কত তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে যায়। কত সজীব, আত্মত্যাগী যুবক ব্রিটিশ সরকারের নৃশংস অবিচারের শিকার হয়, কত নারী এই আত্মঘাতী বিপ্লবের পুরুষের সহযোদ্ধার ভূমিকায় নামে সেই পীড়াদায়ক অভিযানের স্পষ্ট গল্পকথা এই চার অধ্যায়। শৈশবকাল থেকে সনাতনী মায়ের সংস্কারাচ্ছন্ন আচার নিষ্ঠতা এলা কখনই আমলে নেয়নি। আধুনিক বাবা এবং প্রাচীনপন্থী মায়ের টানাপোড়েনে এলা পিতার আদর্শিক বোধেই উদ্বুদ্ধ হয়। এলার শারীরিক রূপ নির্ণয়ে কবি তাকে লক্ষ্মী প্রতিমার আদলে গড়ে তোলেন আর মানস গড়নে সে হয় নবদ্যুতির বার্তাবাহক। একজন নিবেদিত বিপ্লবী বিপরীত সামাজিক পরিস্থিতিতে যা যা মোকাবেলা করে এলাকেও সবটাই করতে হয়েছে। এখানে নারী বলে কোথাও তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, আদর্শিক দায়বদ্ধতায়ও কোন কালো ছায়া পড়েনি। ফলে এই আত্মঘাতী বিপ্লবী দলের সহযোদ্ধা হয়ে কোন সর্বনাশকে সে আটকাতেও পারেনি। ঘর বাঁধার স্বপ্নভঙ্গ হয়। শেষ পরিণতিতে অতীনকে সর্বস্ব দিতে চেয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় অনিবার্য আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। শাসন-শোষণের বিক্ষুব্ধ আবহে উদ্দীপ্ত তরুণ বিপ্লবীদের অন্তিম পরিণাম যা হয় এলাও সেই অন্তহীন পথকে বেছে নেয় বিপ্লবের দৃঢ় মন্ত্রবলে, আর এলার স্রষ্টাই এই অকুতভয় বিপ্লবীকে যথার্থ মর্যাদা দিতে গিয়ে সর্বশেষ যাত্রায়ও তাকে নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ সমর্পণ করেন।
×