ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ৩ আগস্ট ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পর্ব-১৫) বস্তুতপক্ষে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমরা কখনই প্রত্যক্ষ রাজনীতি বিবর্জিত নাটক করার সুযোগ পাইনি এবং যেহেতু শিক্ষা-দীক্ষায় আমাদের অপ্রাচুর্য ছিল সেহেতু আমাদের সৃজনশীল কর্মকা-ে আমরা জীবনের গভীরে প্রবেশ করার ব্যাপারেও সচেষ্ট ছিলাম না। হাতের কাছে মুখরোচক বিষয় ছিল রাজনীতি এবং এই রাজনীতিও গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত ছিল না। অতএব, আমাদের জীবনে এবং শিল্পকর্মে মোক্ষ হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির চটুলতা। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে আমাদের বেশিরভাগ জনপ্রিয় নাটক প্রায় সর্বদাই রাজনীতি নিয়ে, হাসি-ঠাট্টার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এখনও তাই আছে। একেক সময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলতাম যে ফুটপাথে আড্ডা দেয়ার সময় কিংবা বৈঠকী সম্মিলনে যে সকল চুটকি আমাদের তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয় সেই সবই গ্রন্থনা করে তৈরি হয় আমাদের নাটক এবং আমাদের দর্শক মানসিকতাও বিষয়বস্তুর ওই অপরিপক্বতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে আজকের নাটকে, বিশেষ করে টেলিভিশনে, যা দেখি তাকে ভাঁড়ামো ছাড়া কিছু বলা যায় না। আমরা এবং আমাদের কিছু নাট্য সহযাত্রী চেষ্টা করেছেন মঞ্চে কিংবা অন্যত্র কিছু ভাল নাটক পরিবেশন করার। এর মধ্যে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, ব্রেশ্ট, চেখভ, ইবসেন, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন এবং অন্য প্রথিতযশা নাট্যকাররা ছিলেন। তবে নাটকের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হাল্কা রসের প্রাধান্য এবং নাট্যকর্মীর মেধাশূন্যতা বিরক্তিকরভাবে আমাদের নাটককে পঙ্গু করে দিয়েছে। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে নাটক যেন একটি মেধাশূন্য নিষ্ফলা মাধ্যম হিসেবেই কেবল কোন মতে বেঁচে না থাকে সেই চেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে যারা শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চায় আগ্রহী তাদের। একটি স্বাধীন জাতির জীবনে প্রায় পঞ্চাশ বছর খুব কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যেই আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত ছিল একটি বুদ্ধিমান এবং চিন্তাশীল জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার। এইটি সম্ভব হয়না কখনই যদি স্বাধীনতার অর্থই হয় কেবল রবার স্ট্যাম্পের পরিবর্তন। নতুন অর্থ দিয়ে খোলনলচে পাল্টে ফেলতে না পারলে সেই পুরনো পথেই পথ চলতে থাকে একটি জাতি। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করার যে আন্দোলন তার পেছনের মূল চালিকাশক্তি হলো কিছু মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং নতুন জাতি সত্তার আদর্শ অনুসরণ করে কিছু নতুন মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। আমরা দেখি যে এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমরা সব সময় প্রায় উদাসীন ছিলাম। আমাদের দেশ, জাতি এবং রাজনীতি নিয়ে কোন আলাপ- আলোচনা উঠলেই আমরা সাধারণত সব বিষয়ে আমাদের রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করি। ভুলে যাই যে, তাদেরও জন্ম এমন একটি সমাজে যে সমাজ উপনিবেশবাদের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে লালিত হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে তারা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই ভেবেছেন হয়ত। সামগ্রিকভাবে একটি সমাজের চিন্তা-চেতনা, দর্শন এবং প্রত্যয়কে নিয়ে যিনি চিন্তা করেন তাকে হতে হয় একজন সমাজ সংস্কারক। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ধরনের ব্যক্তি না থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামের অভীষ্ট লক্ষ্য কখনই অর্জন সম্ভব হয়না। আমরা জানি যে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করি। এই মুক্তি শব্দটি একটি বিশাল তাৎপর্য বয়ে নিয়ে আসে। মুক্তি মানে কেবল রাজনৈতিক, ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়। মুক্তির অর্থ বোধ, বুদ্ধি, দর্শন এবং উপলব্ধি সব কিছুরই মুক্তি বটে। এইটি বড় সাহসের বিষয়। এই মুক্তির প্রশ্নে এসেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে এক ধরনের শঙ্কা উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছে করে, এতদিনের অভ্যেস ছাড়ব কি করে? অথবা, এতদিনের বিশ্বাস পাল্টাব কিভাবে? অতএব আমরা নিরাপদ আপসের পথটি বেছে নিই। এই কারণেই স্বাধীন দেশেও আমরা পুরনো মর্চে পড়া পচনশীল চিন্তা-চেতনা নিয়ে দিব্যি বিচরণ করি। একজন শিল্পী কখনই পূর্ণ শিল্পী হতে পারে না যদি না সে প্রচলিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস বুকে না ধরে। অবশ্যই তার চিন্তাতেও ভুল থাকতে পারে কিন্তু তার নতুন চিন্তাই তো প্রতিষ্ঠিত সত্যকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলে। আমি এই পরিণত বয়সে এসে আবিষ্কার করেছি যে আমাদের জীবনে বোধহয় সবচেয়ে মূল্যবান শব্দটি হচ্ছে ‘কেন’। যে কোন বিষয়ে এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারি। পরবর্তীতে কখনও এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনার ইচ্ছা রাখি।
×