ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রান্নাঘরের ঘড়ি

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ৩ আগস্ট ২০১৮

রান্নাঘরের ঘড়ি

দূর থেকেই তাকে দেখা যাচ্ছিল। ওদিকে এগিয়ে গেল তারা। লোকটা নিশ্চল। অনেকটা বৃদ্ধের মতো চেহারা। তবে বলে রাখা ভাল, আদতে তার বয়স বিশের মতো হবে। লোকটা তার বৃদ্ধচেহারা নিয়েই তাদের পাশের বেঞ্চে বসল। পরে হাতে থাকা জিনিসটা দেখাল- ‘এটা আমাদের রান্নাঘরের ঘড়ি ছিল।’ লোকটা বলল। কথা শুনে সবাই ওটার দিকে তাকাল। ওরা রোদে পেতে রাখা একটি বেঞ্চে বসে আছে। একে একে সবাই দেখল ওই ঘড়িটা। ‘হ্যাঁ, আমি ওটা খুঁজে পেয়েছি। ওটা এখনও টিকে আছে।’ চায়না সাদা রঙের এই রান্নাঘরের ঘড়িটা গোলাকার। ওটাকে হাতে তুলে ধরে রইল সে। নীল রঙের পেইন্ট করা নম্বরগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল ‘এটি এখন মূল্যহীন!’ অনেকটা ক্ষমা চাওার মতো করে আবার বলল, ‘আমি নিশ্চিত জানি, ওটার বিশেষ কোন আবেদনও নেই। মসৃণ সাদা বার্নিশ করা প্লেটের মতো চেহারাটা ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু দেখ, নীল নম্বরগুলো কেমন চমৎকার লাগছে! মনে হচ্ছে প্রাকৃতিক কোন হাত এসে এই টিনের ওপর ছাপ রেখে গেছে। এর পর তারা ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। নিশ্চিত ঘড়িটার ভেতরের অংশগুলো ভেঙ্গে গেছে। তবে দেখে মনে হয় এখনও যেন চলছে। কিন্তু ওটা আর কখনও কাজ করবে না, এটাই বাস্তব।’ আঙ্গুল দিয়ে প্লেটের মতো ঘড়িটার চারপাশে একটি সতর্ক বৃত্ত আঁকল সে। এরপর ধীরে ধীরে বলল- ‘এর আর কীই বা অবশিষ্ট আছে?’ ওর কথা শুনল না কেউ। এমনকি তাকালও না। তারা রোদে পেতে রাখা বেঞ্চে বসেছিল। তবে এদের একজন ওর জুতাজোড়ার দিকে দৃষ্টি দিল। এক নারী তাকিয়ে আছে তার শিশুকে রাখার গাড়িটার দিকে। তারপর একজন বলল- ‘বুঝলাম তুমি সব হারিয়েছ। এর পর কী হলো?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ সে গলায় জোর এনে বলল- ‘ভাবতে পারো একবার! সত্যিই সবকিছু? কেবল ওটাই টিকে আছে। ওটাই কেবল বাকি আছে।’ সবার মনোযোগ টানার চেষ্টায় ঘড়িটা আবার তুলে ধরল সে। এক নারী বলল, ‘কিন্তু ওটা তো আর কাজ করবে না।’ ‘না, না আর কাজ করবে না। ওটা ভাঙ্গা, আমি জানি ওটা ভাঙ্গাই থাকবে। কিন্তু ওটা এখনও তো টিকে আছে। সব সময়ই সাদা এবং নীল রং নিয়েই টিকে আছে।’ আবার সে তাদের ঘড়িটা দেখাল। এবং আবেগ ধরে রাখতে পারল না। সে বিড় বিড় করে বলতেই থাকল- ‘খুব সুন্দর জিনিস।’ ‘আমি এখনও পর্যন্ত আসল ঘটনাটা খুলেই বলিনি। এই ঘড়িটা আসলে সেরা জিনিস। একবার ভেবে দেখ তো, ঘড়িটা ঠিক কেন আড়াইটার কাঁটায় থেমে আছে? সব সময়ের জন্যই ওটা এই আড়াইটায়ই থেমে গেছে, ভেবে দেখ!’ ‘এর মানে নিশ্চিত, তোমার বাড়ির ওপর আড়াইটার সময়ই বোমা পড়েছিল?’ এক লোক তার নিচের ঠেঁাঁট ঝুলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটা বলল। ‘আমি শুনেছি, বোমা পড়ার পর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। বোমা পড়ার চাপে ঘড়ির কাটা আড়াইটায় এসে স্থির হয়েছে।’ সে অবাক হয়ে ঘড়িটার দিকে তাকাল। তারপর এপাশ-ওপাশ মাথা দোলাতে থাকল, ‘না, জনাব না, তুমি ভুল বুঝছ। বোমার প্রভাবে ঘড়ির কাঁটা আড়াইটায় এসে থামেনি। আর সবসময় বোমার সঙ্গে বিষয়টা মেলানোর চেষ্টা করাও ঠিক না। আড়াইটার অন্য রকম একটা ব্যাখ্যা আছে। যখন আড়াইটা বাজত, অন্য রকম কিছু একটা ঘটত। তোমরা সেটা জানো না। ঘটনাটা বেশ মজার, ঘড়িটা একেবারে আড়াইটার কাঁটাতেই বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইটা বলতে আড়াইটা-ই। আরো মজার তথ্য হলো, আমি প্রায় প্রতিদিনই রাত আড়াইটার সময় ঘরে ফিরতাম। প্রায় সব সময়ই আড়াইটায়। মজার না!’ সে সবার দিকে তাকিয়ে বিপুল উৎসাহ নিয়ে কথাগুলো বলল। কিন্তু তাদের চোখ ছিল আরও অনেক দূরে, অন্যদিকে ঘোরানো। সে তাদের মনোযোগ টানতে পারেনি। তাই আবার ঘড়িটাকে অবলম্বন করতে হলো : ‘তারপর, ওই সময় স্বাভাবিক হিসেবেই আমার ক্ষুধার্ত থাকার কথা, তাই না? সে কারণেই সরাসরি রান্নাঘরে চলে যেতাম। সময়টা কিন্তু রাত আড়াইটা। তারপর, তারপর, আমার মা ঠিকই টের পেয়ে যেতেন। আমি দরজা খুলতাম চুপিচুপি, নিঃশব্দে, আলো জ্বালাতাম সাবধানে। কিন্তু তবুও রান্নাঘরে খাওয়ার জন্য গেলে মা যেন কিভাবে টের পেয়ে যেতেন। তিনি সব শুনে ফেলতেন। উলের জ্যাকেটটার সঙ্গে লাল শাল জড়িয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন। বলে রাখা ভাল, আমাদের রান্নাঘর ছিল টাইলস করা। তিনি খালি পায়ে চলে আসতেন, আমি শব্দ শুনতাম না। এসেই বাতির উজ্জ্বল আলোর মুখে পড়তেন। তার চোখ ছোট হয়ে যেত। পিট পিট করে তাকাতেন। বোঝাই যেত, এই রাতে তিনি মাত্র ঘুম থেকে জাগলেন। ‘আবারও দেরি করে ফিরেছো, মা শুধু এই কথাটিই বলতেন। এর বেশি আর একটি শব্দও না, কেবল : ‘আবারও দেরি করে ফিরেছ।’ এরপর তিনি আমার জন্য গরম খাবার তৈরি করতেন, আমি সময় নিয়ে খেতাম। ওদিকে তাকিয়ে থাকতেন। মা যখন কাজ করতেন, তাকে দেখেছি পা গরম রাখার জন্য এক পায়ের ওপর অন্য পা ঘষাঘষি করতেন। ঘরের টাইলসগুলো খুব ঠা-া ছিল তো! মা রাতে কখনও জুতা পরতেন না। আমার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় আমার সঙ্গেই বসে থাকতেন। পরে আমি যখন আমার কামরায় গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিতাম, তখনও রান্নাঘরে মায়ের প্লেট গোছানোর ঝন ঝন শব্দ পেতাম। প্রতি রাতেই একই রুটিন ছিল। প্রায় সব সময়ই আড়াইটায়। এটাই পূর্ণাঙ্গ একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি আবিষ্কার করলাম, মা প্রতি রাতে আড়াইটার দিকেই আমার জন্য রান্নাঘরে খাবার বানাতেন। আমি সেই খাবার খেতাম। তিনি বেশি কিছু বলতেন না। কেবল বলতেন, ‘আবারও দেরি করে ফিরেছ।’ তিনি এটা সব সময়ই বলতেন। আমি ভাবতাম, এই কথা চলতেই থাকবে, কখনও থামবে না। এতেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম। দীর্ঘ সময় বেঞ্চের কেউ কোন কথা বলল না। ধীরে ধীরে সে আবার বলল, ‘এখন?’। এরপর অন্যদের দিকে তাকাল। কিন্তু তার দিকে কারও মনোযোগ আছে বলে মনে হলো না। পরে হাতে থাকা ঘড়িটার সাদা এবং নীল রঙের গোলাকার চেহারার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো- ‘এখন। এখন আমি জানি ওটা ছিল একটা স্বর্গ। ওটা সত্যিই স্বর্গ ছিল।’ তখনও বেঞ্চের নীরবতা ভাঙল না। একটু পর এক নারী জিজ্ঞেস করল ‘তোমার পরিবারের কী হলো?’ সে একে একে সবার চেহারার দিকে তাকাল। ভয়ে ভয়ে একটু হাসল। কিন্তু তারা তাকে দেখতে পে না। আবার তার ঘড়িটার প্রয়োজন দেখা দিল। হাতে রাখা ঘড়ি আবার তুলে ধরল। সেই সঙ্গে সে হাসল। হাসতে হাসতেই বলল : ‘কেবল এটাই আছে। এটাই টিকে আছে। নিষ্ঠুর হলেও সত্য, এটা এখন বন্ধ, সব সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে আড়াইটার কাটায়। আড়াইটায় আটকে আছে সকল সময়।’ এর পর সে আর কিছু বলল না। কিন্তু তার সেই বৃদ্ধ চেহারাটা বৃদ্ধের মতোই রয়ে গেল। পাশে বসা লোকটি তার জুতাজোড়ার দিকে তাকাল। কিন্তু সে নিজে জুতাজোড়া দেখতে পেল না। সে কেবল ভাবছে একটি শব্দ নিয়ে- স্বর্গ। উলফগ্যাং বোর্চার্ট : জার্মান লেখক এবং নাট্যকার ছিলেন। তার জন্ম ১৯২১ সালের ২০ মে এবং মৃত্যু ১৯৪৭ সালের ২০ নবেম্বর। তার লেখায় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রভাব রয়েছে। ‘রান্নাঘরের ঘড়ি’ গল্পটিও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা। তার পরিচিত একটি নাটকের নাম ‘ম্যান আউটসাইড’। যুদ্ধফেরত এক সৈন্যের আশাহীনতার গল্প নিয়ে এই নাটকটি লেখা।
×