ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খান মোহাম্মদ ফারাবী, কেন স্মরণীয়

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ৩ আগস্ট ২০১৮

খান মোহাম্মদ ফারাবী, কেন স্মরণীয়

বেঁচে থাকলে কী হতে পারতেন, অজানা। হয়তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় অধ্যাপক, নামী অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (ওগঋ) বড় কর্তা, উপদেষ্টা। মনে রাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন অর্থনীতির উজ্জ্বল, প্রতিভাবান ছাত্র। সরকারী আমলা বা অর্থমন্ত্রী? স্থির বিশ্বাস, না, হতেন না। কেন না, তাঁর অস্থিমজ্জায় আমলাতন্ত্র, মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, শাসক ঘোরতর পীড়াদায়ক। অন্তত যতটুকু জানতুম তাঁকে। বরং শ্রমিক মজুর-সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের পাশেই সহাবস্থান আত্মিক, আত্মীয়তায় গড়িয়ান। মনে রাখি, স্কুলের গ-ি পেরোনোর আগেই তিনি কমিউনিজমে দীক্ষিত। ঘোরতর বিশ্বাসী। ছাত্র ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ কর্মী। জীবনও চলে গেল কর্মে। যদিও কর্কট রোগে আক্লান্ত, ছাত্র ইউনিয়নে কঠিন, অক্লান্ত পরিশ্রমে, নাওয়া-খাওয়াও ভুলে যাওয়া, শরীরের প্রতি অযতœ, দেশ-মানুষের প্রতি ভালোবাসাই প্রথম ও প্রাথমিক শর্ত, জেনেছিলেন। কর্কট রোগ তক্কে তক্কে ছিল, ঠিকই বাসা বাঁধে, স্থায়ী আস্তানা গেড়ে সর্বভুক। যদি বাঁচতেন, নিশ্চিত, খান মোহাম্মদ ফারাবী, বহুমানিত প-িত, বুদ্ধিযোগী, দার্শনিক এবং খাঁটি, বিরল লেখক কুলেরও ঈর্ষণীয় লেখক হতেন। প্রমাণ পেয়েছি ছাত্রাবস্থায় তাঁর কিছু লেখায়। প্রবন্ধে। প্রবল যুক্তিবাদিতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ, তর্কও উস্কে দিয়েছেন নানা বিসরণে। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আলাদা, দেশ-মানুষ-রাজনীতি-সমাজ সামাজিকতায় উদ্বেলিত। অনুবাদেও মূল কবিরই কবিতা যেন। ছোটদের লেখায় আবার শিশুতোষ। Ñকী করে এত গুণের ধারক হয় একজন? জানতুম, অসম্ভব মেধাবী। ম্যাট্রিকে দ্বিতীয়। যে কোন কাজে হাত দিলে সুচারু, শিল্পিত না করে ক্ষান্ত নন। সর্বদাই তাঁকে বিস্ময়ের চোখে দেখেছি। সাহস হয়নি কাছে ঘেঁষার, পাছে বিদ্যেবুদ্ধি ধরা পড়ে। খারাপ ছাত্র ছিলুম, ম্যাট্রিকে ফেল, গর্ব ছিল এইটুকু, ছাত্র ইউনিয়নে নিবেদিত কর্মী। ২০ কখন দেখেছে, কোথায় দেখেছে, বিকালে না সন্ধেয়, এই নিয়ে প্রশ্নমালা। আরও প্রশ্ন, আফসানকে ‘তুমি কি করছিলে ওখানে? কেন গিয়েছিলে?’ আফসান ছাত্র ইউনিয়নের চৌহদ্দিতে নেই, সাদী প্রাঙ্গণে, উদ্যানে। মাঠে ময়দান থেকে দূরে। ‘নীরব কর্মী।’ তবে তাত্ত্বিক। কবে থেকে, কোন সমারোহে আমরা চারজন ঘনিষ্ঠ (আহমদ ছফা বলতেন, ‘তোমরা হরিহর। একে-অপরের লেখা নিয়ে মশগুল। পিঠ চুলকিয়ে যা করছো’।), নথিপত্র নেই। প্রমাণ আছে কেবল, আমরা পত্রিকা প্রকাশিত করলুম, নাম ‘পূর্বপত্র।’ প্রথম সংখ্যা ‘পূর্বপত্রে’ গদ্যের আধিক্য, এঁকে ওকে আক্রমণ, মায় গালাগালি। তারুণ্যের বেহিসেবি আস্ফালন। পাঠকমুখে শুনলুম (ডক্টর আহমদ শরিফ, আলাউদ্দীন আল আজাদও) ফারাবীর লেখাই সুপাঠ্য, যুক্তিসঙ্গত, বিচারিক, বিশ্লেষিত। ৩ ফারাবীর প্রতিবেশী, মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায়। প্রায়শ: যাতায়াত। উপলক্ষ লেখালেখি এবং ছাত্র ইউনিয়নের কাজকর্ম। ফারাবী খুব বেশি আসেননি আমাদের আস্তানায়। কুড়ি-তিরিশবার হতে পারে। ফারাবী জিজ্ঞেস করলেন একদিন, ‘তোমার ডাক নাম খোকন কেন?’ উত্তরে প্রশ্ন : ‘তোমার নাম পিয়াল কেন?’ ফারাবী ॥ শাল-পিয়াল। পিয়াল মানে বন, গাছ। গাছগাছালি। Ñ‘তুমি কচি বটগাছ।’ বলি। আরও বলি, ‘প্রিয়াল শ্রুতিমধুর। প্রিয়াল আর পিয়াল একই মানে।’ ‘তুমির বদলে ‘তুই’ সম্বোধন করি। পিয়াল কিছুতেই ‘তুই’ বলবেন না। ওঁর যুক্তি ‘তুমি আমার ৬ মাসের বড়। ‘তুমি’, ‘তুই’-য়ের বদলে ‘কমরেড’ বলবো। দুই কুলই রক্ষিত।’ Ñএই নিয়ে হাসাহাসি। ‘তুমি’ই শেষ অবধি টিকে যায়। মোটরবাইক কিনবেন, বলছিলেন। বিশ্বাস হয়নি। এক সন্ধ্যায় মোটরবাইক নিয়ে হাজির। বললেন, চলো। ঘুরে আসি। বলি, চড়বো না। এ্যাকসিডেন্ট করবে। বেঘোরে মরার ইচ্ছে নেই। তুমি মরো। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে চড়ো, একসঙ্গে মরো, ল্যাটা চুকবে। Ñযে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল (ফারাবীর দিকে সলজ্জ দৃষ্টি) তাঁরই কী বাঁশি শুনেছিল পিয়াল? প্রিয়াল? Ñজানার সুযোগ হয়নি আর। একটি কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ জেলে ঢুকেছি। আছি দিব্যি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুকুল দেখা করতে আসেন, কখনো-কখনো। বন্ধুরা বলেন কোন বন্ধুর হালহকিকত কি। ফারাবীর কথা কেউ বলেন না। ধারণা ওঁদের, ফারাবীর কথা জানি। বললে, জেলজীবন আরও দুঃসহ হবে। হয়তো ভেঙে পড়ব। আকাশপাতাল উথালপাতাল হবে। অসহায়, একাকিত্বে দিনরাত্রির ফারাক থাকবে না। মুক্তি পাই মে’র (১৯৭৪) তৃতীয় সপ্তাহে। শর্ত, নির্বাসনে যেতে হবে। বাংলাদেশের কোথায়ও থাকা নিরাপদ নয়। গেলুম কলকাতায়। বন্ধুরা জেনেছেন ঠিকানা। আফসান চৌধুরীর চিঠি পাই। মর্মান্তিক খবর। কলকাতা-ভারত অগ্নিকু- মনে হয়। রোদনের ভাষা নেই। ধ্বনি কেবল চরাচরব্যাপী। যখন জেলে ছিলুম, খান মোহাম্মদ ফারাবী মারা গেছেন। মৃত্যু তারিখ ৫ মে, ১৯৭৪। বন্ধুদের নিয়ে ফারাবী কখনো জন্মদিন ২৮ জুলাই ১৯৫২ পালন করেননি। তখন, চলও ছিল না তেমন। থাক বা না থাক, ফারাবীর জন্মদিন-মৃত্যুদিন বাংলাভাষা, বাংলাদেশের জন্য আনন্দের এবং ক্ষতিকর। তিনি সর্বদা স্মরণীয়। ৪ এক বিকেলে, ছাদে পায়চারি করছি। রাস্তায় চোখ গেল। দেখি পিয়াল, সঙ্গে তৃণা। বছর ৩-৪ হবে। ভাইয়ের হাত ধরে ড্যাং ড্যাং করে আসছে। ওপরে উঠতেই ভাবী (আনিসা হায়দার। রশীদ হায়দারের স্ত্রী।) আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী। চটপট উত্তর, ‘টিনা, টিনা’। ভুল শুধরে পিয়াল বললে, ‘তৃণা।’ অমনি মুখ ভারী। ঠোঁট ফুলিয়ে গোমড়া মুখ। যাবার সময় পিয়ালের কাঁধে, হাসিখুশি। ৫ দৈনিক সংবাদ-এ সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদনায় থাকাকালীন বহুবারই গদ্য চেয়েছি (কবিতা চাইনি) পিয়ালের কাছে। ‘দেবো, দিচ্ছি’ শুনিয়েছে। রাগ করলে অজুহাত ‘পড়া নিয়ে, ছাত্র ইউনিয়নের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।’ বলি, ‘রাখো তোমার ব্যস্ততা। লেখা চাই। কবে দেবে?’ উত্তর : ‘শীঘ্রই’। সেই শীঘ্রই আসেনি। ‘বাংলাদেশের কবিতা’ সম্পাদনা করি। সংকলন প্রকাশিত কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশন এমসি সরকার থেকে। প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৫ সাল। এখন তৃতীয় সংস্করণ চলছে। খান মোহাম্মদ ফারাবীর দুটি কবিতা সংকলিত। ‘বাংলাদেশের কবিতা’ পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিহারের পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। বাংলা বিভাগে। ফারাবীর যে দুটি কবিতা সংকলনে প্রকাশিত, তুলে দিচ্ছি এখানে। ২১জুলাই ২০১৮ বার্লিন, জার্মানি। আমি তো তোমারও জন্য আমি তো তাদেরই জন্য সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবার অভ্যাসে যারা বন্য। আমি তো তোমারও জন্য কপাল-জ্বালানো যে মেয়ের টিপে রক্তের ছোপ ধন্য আক্ষেপ এখন রাত অনেক রাত নির্দ্বিধায়। আঁধার স্রোত নীরব স্রোত থমকে যায়। প্রচুর গান বন্দীগান সরব হয়। ঘাসের দল শিশির দল কি-ই-বা কয়? ইচ্ছা সব স্বপ্ন সব যন্ত্রণায় নিভছে কি উবছে কি ধোঁয়ার ন্যায়? অনেক সাধ ভাতের সাধ আলোর ন্যায় জ্বলছে আজ ফুটছে আজ দেশের গায়। অনেক শীষ ধানের শীষ মুখর হয়। তবু তো ঘর আমার ঘর শূন্য রয়।
×