ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম বাবু

বই পরিচিতি ॥ অনুপম ইতিহাসগ্রন্থ

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ৩ আগস্ট ২০১৮

বই পরিচিতি ॥ অনুপম ইতিহাসগ্রন্থ

‘উড়িষ্যা কামরূপ বিজয়ী বাঙালী বীর কালাপাহাড়’ শিরোনামে চমৎকার এ বইটি বেরিয়েছিল ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায়। ভালো হোক মন্দ হোক, আজকাল আমাদের কবি লেখকরা একুশকে প্রকাশনার ধ্রুবতারা মেনেই বই প্রকাশে নজর দেন। এটাই আমাদের এখন চর্চা হয়ে গেছে। পরিবেশ সাংবাদিকতায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সরদার আবদুর রহমান সেদিক থেকে ব্যতিক্রম হতে চাননি। প্রকাশ মুহূর্তে বইটি পাঠকমহলে একরকম সাড়া জাগিয়েছিল বলে শুনেছি। বইটি যোগাড় করেছি অনেক পরে। বইটিতে ইতিহাসের একজন খ্যাতনামা সেনাপতির জীবন ইতিহাস ঘিরে হলেও উপন্যাসের মতো পড়তে সময় নেয় না। তরতর গতিতে এগিয়ে যায়। বলতে গেলে বইটি সুবোধ্য গদ্যের গুনে ধনিত বললে কম বলা হবে। অবশ্য সরদার আবদুর রহমান কালাপাহাড়-এর সংগ্রামী জীবন কাহিনী নিয়ে একেবারে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ লিখবেন, সেটা আমাদের একরকম ধারণার অতীত ছিল। গল্প, ছড়ার পাশাপাশি পরিবেশ তার লেখার অন্যতম উপপাদ্য বিষয় হলেও- এখন বোঝা যাচ্ছে ইতিহাসও তার প্রিয় অনুসন্ধিৎসু বিষয়। তার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়া গেল আমদের আলোচ্য গ্রন্থে। সরদার আবদুর রহমান এমন একজন সংগ্রামী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে গবেষণা কাজে হাত দিয়েছেন, যার পরিচিতি কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সত্য মিথ্যা ও জমজমাট কিংবদন্তি একাকার হয়ে গেছে। গ্রন্থাকার আবদুর রহমান প্রধানত দুটি কারণে এই সৃজনে মগ্ন হয়েছেন। প্রথমত, অনেক কিংবদন্তির জটাজাল ছিন্ন করে সত্যের আলো ফেলে আসল তথ্য সুপ্রচুর অনুসন্ধানে মগ্ন হয়েছেন। বাদ দিয়েছেন সে সমস্ত তথ্য যার সঙ্গে ইতিহাসের তেমন ধারাবাহিক সম্পর্ক নেই। কেননা লেখক ঐতিহাসিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয়ত, ‘কালাপাহাড়’ নামটা উচ্চারণ করলেই তিনি মন্দির-মূর্তি ধ্বংসকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। তবে কালাপাহাড়বিদ্বিষ্ট কিছু লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে এইগুলো অতি বিকৃত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সরদার আবদুর রহমান কি সেই অসুস্থ মানসিকতাকে আঘাত করার জন্য এই গ্রন্থ সৃজন করেছেন? আসলে তা নয়। কিছুটা আত্মজিজ্ঞাসা বোধও এর পেছনে কাজ করেছে। কালাপাহাড়ের জন্মস্থান হলো, রাজশাহী তথা বরেন্দ্রভূমির নওগাঁর বীরজোয়ান গ্রামে। শৈশবের নাম ছিল রাজু বা রাজীব লোচন। এত বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব কেবলমাত্র বিদ্বেষমূলক আলোচনার গ্রন্থই থাকবেন সেটা ভালো দেখায় না। গ্রন্থাকার সরদার আবদুর রহমান তাঁর নিরপেক্ষতা ও পরিশ্রমী মানসিকতার ভেতর অবস্থান করে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেই দিক থেকে লেখক কতখানি সফল হয়েছেন, তা অবশ্যই আলোচনা পর্যালোচনার বিষয়। তবে এটা ঠিক যে কালাপাহাড় জন্মগত মুসলমান ছিলেন না। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি মুসলমান হয়েছিলেন। কোন ঐতিহাসিক অবশ্য এর নেপথ্যে বিবাহের কারণ উল্লেখ করেছেন। এর জন্য তাকে হিন্দু সমাজে মারাত্মক বিদ্বিষ্ট অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি নাকি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। সেই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন গ্রন্থাকার নিজেই। তবে এটা ঠিক যে সেই আমলে মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। গবেষক-লেখক গোলাম মুর্শিদ যখন বলেনÑ ‘খিলজি ও তার পরবর্তী শাসকরা হিন্দুদের মন্দির ও আক্রমণ করেছিলেন কারণ সেখানে সোনাদানা ছিল।’ গোলাম মুর্শিদের মন্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার লেখক ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সোমানাথ মন্দিরে সুলতান মাহমুদের আক্রমণ বিষয়ে তার মতামতকে। তবে এই গ্রন্থের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে যে দিকটি, সেটি হলো এই যে, সেই সময়কার জটিল সামাজিক চিত্র। হিন্দু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বিষ্ট বিষবাষ্প সারা সমাজকে এতটাই কলুষিত করেছিল, যার ফলে মুসলমান সম্প্রদায়কে ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। এই শতাব্দীতে তার প্রমাণ রেখে গেলেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার। অধিকাংশ ঐতিহাসিক যখন স্বীকার করলেন রাজু ওরফে রাজীবলোচন ছিলেন কালাপাহাড়। তিনি একবাক্যে সেই তথ্য নাকচ করে দিয়ে বললেন কালাপাহাড় ছিলেন একজন আফগান মুসলমান। সরদার আবদুর রহমান কষ্ট করে নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কালাপাহাড় উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলার একজন বাসিন্দা। তবে এই গ্রন্থের মূল আকর্ষণ হলো সেটি যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সমস্যামূলক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এই রকম আর্কষণীয় ভাষার ব্যবহার সাম্প্রতিককালের কোন ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থে দেখা যায়নি। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন সেটা কেমন করে বলছি। সূত্রাকারে দেখুন : ক. কালাপাহাড় কি সাম্প্রদায়িক ছিলেন? -না, মোটেও নয়। খ. ধর্মান্তরিত বিষয়ে মতবিরোধ- এর উত্তর পরিবেশ তাকে বাধ্য করেছিল। তবে এত বড় অসাম্প্রদায়িক বীরের মৃত্যু নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এটাই হলো এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিক দিক। যা আমাদের খানিকটা ব্যথিত করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই গ্রন্থ পাঠের আমাদের সার্থকতা কি? এর উত্তর আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে এই গ্রন্থ পাঠ অত্যন্ত জরুরী। সুবোধ্য গদ্যে সরদার আবদুর রহমান এই গ্রন্থে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যিকের দীপ্র মানিসকতা থাকলেই এই রকম ঐতিহাসিক গ্রন্থ সৃজন করা যায়। এই মুহূর্তে তাকে একজন সফল লেখকের মর্যাদা দিতে দ্বিধা থাকে না। ঐতিহাসিক টয়নবির মতন সত্যকে আবিষ্কারের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তিনি চালিয়েছেন। বইটি প্রকাশ করেছে ‘হেরিটেজ রাজশাহী’ প্রকাশনী যে বরেন্দ্র জীবনী গ্রন্থমালা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে এটি তার প্রথম বই। পরিবেশক : মধ্যমা পাবলিকেশন্স, কাঁটাবন, ঢাকা। গ্রন্থটির বহিঃসাজসজ্জা ( এবঃ ঁঢ় ধহফ গধশব ঁঢ়) খুব আকর্ষণীয়। প্রচ্ছদ তৈরির নেপথ্যে রয়েছে গালিব সর্দার। তাদের সবাইকে অভিনন্দন। ১২০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে দুইশত টাকা মাত্র। পাঠকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। জাতির জন্য অত্যন্ত জরুরী এই গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×