ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাশিয়ার ফুটবল ঘিরেই তার যত স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৩ আগস্ট ২০১৮

রাশিয়ার ফুটবল ঘিরেই তার যত স্বপ্ন

শ্রাবনী আক্তার সান ॥ ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সার্টিফিকেট, ‘এটাই ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ’। আয়োজনের দিক দিয়েই কেবল নয়, মাঠের ফুটবলেও বিশ্ববাসীর মন কেড়ে নিয়েছে রাশিয়া। অপ্রত্যাশিতভাবে দুর্দান্ত খেলেছে স্বাগতিকেরা। নকআউটে স্পেনকে বিদায় করেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে এসে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হার টাইব্রেকারে। মন খারাপ না করে রাশিয়া ফুটবলের ভবিষ্যত ঘিরেই স্বপ্ন দেখছেন দলটির কোচ স্ট্যানিস্লভ চেরশেসোভ, ‘হয়ত শিরোপা জিততে পারিনি, সেমিতেও যাইনি। কিন্তু আমরা নিজেদের গুরুত্ব (বিশ্ব ফুটবলকে) দেখাতে পেরেছি। প্রথম এবং দ্বিতীয় সারি থেকে দল তৈরি করেছি। আমি জানতাম, এরা কোথায় যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস, আমরা সফল হয়েছি। এখন সময় আরও এগিয়ে যাওয়ার।’ বলেন তিনি। পুরো আসরেই রাশিয়ার খেলা নজর কেড়েছে সবার। ইউরোকে লক্ষ্য রেখে কোচ চেরশেসোভেই আস্থা রাখছে রাশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। তার সঙ্গে দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে রাশিয়া। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কোচ থাকছেন তিনি। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে র‌্যাংকিংয়ে সবার নিচে থেকে বিশ্বকাপ শুরু করা রাশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-যুগের পর বিশ্বকাপের সেরা সাফল্য। শেষ ষোলোয় ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে কোয়ার্টারে উঠেছিল রাশিয়া। ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় স্বাগতিকরা। বিশ্বকাপ সাফল্যের জন্য রাশিয়ার সাবেক গোলরক্ষক ৫৪ বছর বয়সী চেরশেসোভকে ধন্যবাদ জানিয়েছে রাশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। তাঁকে সম্মাননা ও বিশাল অঙ্কের পুরস্কার দিয়েছেন খোদ দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ২০১৮ বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে চার গোল করেছেন রাশিয়ান মিডফিল্ডার ডেনিস চেরিশেভ। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও করেছেন দুর্দান্ত এক গোল। তাঁর গোলেই সেদিন শুরুতে এগিয়ে যায় রাশিয়া। সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই প্রসঙ্গ টেনে কোচ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় পুরো দল নিজেদের শতভাগ দিয়ে খেলেছে। শুধু জয়টাই পাইনি। আমার মনে হয় টাইব্রেকার এক রকমের লটারি।’ রাশিয়ান কোচ বলেন, ‘আমরা সবাই নিজেদের ওপর বিশ্বাসী ছিলাম। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরতে চেয়েছিলাম আমরা। আমার বিশ্বাস সমর্থকরা আমাদের ওপর শুধু ভরসাই করেনি, তারা আমাদের ভালও বেসেছিল। পুরো রাশিয়ার লোকজন আমাদের ভালবেসে ফেলেছিল।’ গর্বিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও, ‘আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হেরে গেছি। তবে আমাদের জন্য তারা খুবই ভাল খেলেছে। তারা সবাই আমাদের কাছে নায়ক এবং তাদের নিয়ে গর্বিত আমরা।’ এবার ঘরের মাঠে কোয়ার্টারে ওঠার আগে ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে বিদায় করে দেয়াটাই ছিল সবচেয়ে বিস্ময়কর সাফল্য রাশিয়ার জন্য। তবে গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব অতিক্রম করাটাও সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। স্বাগতিক হিসেবে অবশ্য সেটাকে তেমন অস্বাভাবিক ভাবতে পারেননি কেউ। কিন্তু স্পেনের মতো শক্তিশালী একটি দলকে টাইব্রেকারের ¯œায়ুচাপে বিদায় করে দেয়াটা রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। এমনকি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও দল দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে স্পেনের মুখোমুখি হওয়ার আগে এক বার্তায় কোচ চেরচেসভকে বলেছিলেন, ‘এখন ফলাফল যেমনই হোক এই দলটিকে কেউ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে না।’ সত্যিই বিষয়টা তেমনই। অপ্রত্যাশিত সাফল্য পাওয়া রাশিয়ানদের নিয়ে সবাই ছিলেন সন্তুষ্ট। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দুরন্ত নৈপুণ্য দেখানো দলটির জন্য বিস্ময়কর ঘটনাই। কারণ এবার অংশগ্রহণকারী ৩২ দলের মধ্যে র‌্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রাশিয়ার অবস্থান ৭০ নম্বরে। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে নিজেদের সেরা সাফল্য ছিল চতুর্থ স্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করা। ৭ বার সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে খেলেছে তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৯৯৪ সালে রাশিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মোট তিন বিশ্বকাপ খেলে গ্রুপপর্ব থেকেই একেবারে নাজেহাল অবস্থায় বিদায় নিতে হয়েছিল। কিন্তু এবার সেই ভাগ্য বরণ করেনি রাশিয়া। খর্বশক্তিমত্তার দল হলেও নিজেদের সামর্থ্যরে প্রমাণটা ভালভাবেই দিয়েছে তারা। বিশেষ করে, টাইব্রেকার নামের ভাগ্যপরীক্ষাটি ¯œায়ুর ওপরে প্রচ- এক চাপ, সেই সঙ্গে প্রত্যাশার চাপের মধ্যে আছে দর্শকদের কামনা, চিৎকার, সমর্থনের বিষয়টি। সেখানেই অভিজ্ঞতম স্পেনের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়েছিল। রাশিয়ার খেলোয়াড়দের সাহস বাড়িয়েছে দর্শকদের পূর্ণ সমর্থন, শক্তি জুগিয়েছে নিখুঁত শটে। আর দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির ইতিবাচক মন্তব্যই খেলোয়াড়দের জন্য ছিল অনেক বড় শক্তির উৎস। তাইতো ইতিহাস রচিত হলো অনুপ্রাণিত দলটির মাধ্যমে। রাশিয়া আগে তিনবার বিশ্বকাপ খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডেই উঠতে পারেনি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে একই পথে যাচ্ছিল ফলাফল। প্রথমেই গোল করে এগিয়ে গেলেও নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হয়ে যায় ১-১ গোলে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ধাপে এগিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। তখন উপস্থিত হাজার হাজার রাশিয়ান স্তব্ধ হয়ে যান। কিন্তু চেরশেসভ বারবার গ্যালারির দিকে হাত উঁচিয়ে নিজের শিষ্যদের অনুপ্রাণিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় ভাগে। সমতা ফিরিয়ে টাইব্রেকার নামের ভাগ্য পরীক্ষায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু গোলরক্ষকের দৃঢ়তা এবং বড় দল হিসেবে চাপ নেয়ার ক্ষমতাকে পুঁজি করেই এবার রাশিয়ার উৎসব থামিয়ে দিতে পেরেছে ক্রোয়েশিয়া। খেলোয়াড়রা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন ও ৪৫ হাজার রাশিয়ান দর্শক নীরব, স্তব্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু পরে রাশিয়া ফুটবল দলের পক্ষ থেকে এক টুইটে বলা হয়েছে, ‘আমরা টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিচ্ছি চোখে অশ্রু নিয়ে, কিন্তু আমাদের মাথা উঁচুই থাকবে।’
×