ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

আইএসের নতুন রণাঙ্গন আফ্রিকা

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৩ আগস্ট ২০১৮

আইএসের নতুন রণাঙ্গন আফ্রিকা

মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইসলামী রাষ্ট্র বা আইএস কার্যত ধ্বংসই হয়ে গেছে। এর অস্তিত্ব বলতে আছে নামটুকু মাত্র আর ইত:স্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আত্মগোপন করে থাকা কিছু জঙ্গী। ফলে জিহাদের মূল রণাঙ্গন এখন মধ্যপ্রাচ্য নয় আইএসের লড়াইয়ের ময়দান স্থানান্তরিত হতে চলেছে অন্যত্র। সেটা আফ্রিকা। আফ্রিকাই হতে চলেছে জিহাদের পরবর্তী রণাঙ্গন। জিহাদীদের তৎপরতার আপাতত কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নাইজিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নগরী মাইদুকুরি। এখান থেকে মোটা দুটি রেখা চলে গেছে আফ্রিকাজুড়ে সাহাবার দু’পাশ দিয়ে। উত্তরের রেখাটি মিসর থেকে লিবিয়া ও তিউনিসিয়া হয়ে আলজিরিয়া পর্যন্ত ভূ-মধ্যসাগর ঘেঁষে বিস্তৃত। দ্রাঘানের রেখাটি পূর্বে সোমালিয়া ও কেনিয়া থেকে নাইজিরিয়া ও নাইজার হয়ে পশ্চিমে মালি, বুরকিনা ফাসো ও সেনেগাল পর্যন্ত চলে গেছে। এই বিশাল ভূ-খণ্ডের মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন রণাঙ্গন। এসব রণাঙ্গনের বেশির ভাগ লড়াইয়ের খবরই প্রকাশ পায় না যদিও লড়াইগুলোতে নিহতের সংখ্যা গত বছর ১০ হাজারের বেশি ছাড়িয়ে গেছে এবং এদের সিংহভাগই সিভিলিয়ান। এর মধ্যে এমন লড়াইও আছে সেখানে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সম্ভবত সর্ববৃহৎ সদস্যগোষ্ঠী জড়িত। এখানকার যুদ্ধ যেমন আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির সৈন্যদের টেনে এনেছে তেমনি টেনে আনছে আইএসএর অবশিষ্ট যোদ্ধাদের। উদ্বেগের ব্যাপার হলো এই যে, যুদ্ধে জিহাদীরাই বাহ্যত জয়ী হচ্ছে। এই অঞ্চলে নিয়োজিত সাড়ে ৪ হাজার ফরাসী সৈন্যের অধিনায়ক সন্ত্রাস দমন অভিযানে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি দাবি করলেও পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। আফ্রিকায় জিহাদীরা যুক্ত এমন সহিংস ঘটনার সংখ্যা ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৩০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। টানা সামরিক তৎপরতা চলেছে আফ্রিকার এমন দেশের সংখ্যা এ সময় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ১২ তে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকার জিহাদী গ্রুপগুলোর অনেকগুলোরই আনুগত্য আল-কায়েদা বা আইএসএর প্রতি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সোমালিয়ার আল-শাবাব, নাইজিরিয়ার বোকো হারাম ও এর বিভিন্ন উপদল এবং মালির জামা নুসরাত আল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন। প্রতিটি দেশের সংঘাত হয়ত স্থানীয় অভাব অভিযোগ থেকে উদ্ভূত। তবে জঙ্গীদের মধ্যে কিছু অভিন্ন আদর্শগত বৈশিষ্ট্য আছে। ২০১১ সালে গাদ্দাফি উৎখাত হবার মধ্য দিয়ে লিবিয়া ভেঙ্গে পড়ার পর এই জঙ্গী গ্রুপগুলোর অনেকের শক্তি বৃদ্ধি পায়। লিবিয়ার অস্ত্রাগারগুলো থেকে অস্ত্র পাচার হতে থাকে এবং সাহারার তল্লাটজুড়ে মানুষ থেকে শুরু করে মাদক পর্যন্ত সবকিছুর চোরাচালান নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। জিহাদীরা একে অপরের কাছ থেকে শিখছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জঙ্গী গোষ্ঠীর কাছ হতে অর্থ ও সমর্থন আদায় করছে। আফ্রিকায় জঙ্গী বিরোধী সবচেয়ে বড় লড়াইটা চলছে নাইজিরিয়ার বোকো হারামের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স ও জার্মানি এক হলে যত বড় হয় আয়তনে প্রায় ততই বড় নাইজিরিয়া আফ্রিকার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও জনবহুল দেশ। লোকসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। আফ্রিকায় আমেরিকার মিলিটারি কমান্ড আফ্রিকমের এক সিনিয়র কর্মকর্তার ভাষায় নাইজিরিয়ার পতন ঘটলে এমন এক বিশাল গহবর তৈরি হবে যে তার মধ্যে আরও ৬/৭ টা দেশও চলে যাবে। নাইজিরিয়া সরকার বোকো হারামকে পরাজিত করেছে বলে দাবি করলেও বাস্তব অবস্থা মোটেও তা নয়। বোকো হারামের জন্মস্থান দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মাইদুগুরিতে। এখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বোকো হারাম বিশ্বের ভয়ালতম সন্ত্রাসী সংগঠন। এদের নৃশংসতার কাছে আইএস এবং আল-কায়দার হিংস্রতাকে হার মানে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ ইউসুফ নামে একজন আলেম। ২০০২ সালে মাইদুগুরির একটি মাদ্রাসা ও মসজিদে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। নাইজিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে অনেক আগে থেকে শরিয়তী আইন চালু থাকলেও ইউসুফের কাছে তা যথেষ্ট কঠোর মনে হয়নি। শরিয়ত কঠোরভাবে বলবৎ করার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ‘বোকো হারাম’ সংগঠন হাউসা ভাষায় যার অর্থ ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা হারাম’, ২০০৯ সাল থেকে তার সংগঠন পুলিশ সেনাবাহিনী ও ভিন্ন তরিকার ইমাম-আলেমদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। সে বছরই তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও গুলিতে মারা যান। পরে তার অনুসারীরা আবুবকর সেকাউয়ের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। ২০১১ সালে তারা রাজধানী আবুজায় পুলিশের সদর দফতর ও জাতিসংঘের একটি ভবন বোমায় উড়িয়ে দেয়। ২০১৪ সালের শেষদিকে তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি প্রদেশের বিশাল তল্লাট দখল করে নেয়। চিবকের একটি স্কুল থেকে প্রায় ৩শ’ ছাত্রীকে অপহরণ করে তারা বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি অর্জন করে। এক পর্যায়ে তারা লড়াই করতে করতে মাইদুগুরিতে প্রবেশ করলে সেখানকার নাইজিরীয় বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু আইএসের মতো খিলাফত কায়েম না করে কিংবা শাসন পরিচালনা না করে বোকো হারাম প্রথমে অরাজকতা সৃষ্টির দিকে নজর দেয়। মসজিদ ও বাজারে বোমা মারে। গ্রামবাসীদের কচুকাটা করে এবং মহিলা ও বাচ্চাদের অপহরণ করে। কিছু মেয়েকে দাস বানিয়ে বেঁচে দেয়। অন্যদের জোর করে মানববোমায় পরিণত করে। ২০১১ এর এপ্রিল থেকে ২০১৭ এর জুন পর্যন্ত এ ধরনের ৪৩৪টি মানব বোমার (আত্মঘাতী বোমাবাজ) অর্ধেকেরও বেশি ছিল মহিলা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী গত বছর বোকো হারাম অন্তত ১৩৫টি শিশুর শরীরে বোমা বেঁধে রেখেছিল। আবুবকর সেকাউয়ের নিষ্ঠুরতার কাছে আইএস ম্লান হয়ে পড়েছিল। ২০১৫ সালে তিনি অবশ্য আইএসের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বোকো হারামের নাম বদলে ইসলামিক সেস্ট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স আইএসওয়াপ) রাখেন। ২০১৬ সালে আইএস আবুমুসার আল বারনাবিকে আইএস ওয়াপের প্রধান ঘোষণা করলে সংগঠনটি দু’ভাবে ভাগ হয়ে যায়। এদিকে জঙ্গী মোকাবিলায় নাইজিরিয়া সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্র শাদ, নাইজার ও ক্যামেরুনকে নিয়ে একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন করে। কয়েক মাসের মধ্যে এই বাহিনী বেশির ভাগ বড় বড় শহর পুনর্দখল করে নেয়। জঙ্গীদের অরণ্যে অথবা শাদ হ্রদে ঠেলে দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, এই হ্রদটা চার দেশের সীমান্তের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এরপর থেকে অচলাবস্থা বিরাজ করছে প্রধান শহরগুলো এবং সেগুলোর মধ্যবর্তী কিছু সড়ক সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে আর গ্রামাঞ্চলে রয়েছে জঙ্গীদের দৌর্দ- প্রতাপ। বোকো হারাম দু’ভাবে ভাগ হওয়ার পর বারনাবির নেতৃত্বে আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার জঙ্গী এবং সেকাউয়ের নেতৃত্বে আছে দেড় হাজার জঙ্গী। তার মানে বারনাবির দায়িত্বেই এখন বিশ্বের বৃহত্তম আইএস বাহিনী। সিরিয়া ও ইরাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব আইএস জঙ্গী আছে তাদের সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজারের বেশি হবে না। আইএস ওয়াপ বোমা তৈরি জানে, নিপুণ আক্রমণ কৌশল জানে। এ ব্যাপারে তারা অন্যান্য জিহাদী গ্রুপের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ পাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু বিদেশী যোদ্ধাও আছে। আক্রমণে এরা কত দক্ষতা অর্জন করেছে তার একটা প্রমাণ দেখা গেছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এদের জঙ্গীরা পার্শ্ববর্তী ইয়োর প্রদেশের ডাপচি শহরে হানা দিয়ে ১১০জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে। ওটা ছিল এক দূরপাল্লার অভিযান গিয়ে আবার জিম্মিদের নিয়ে ফিরে আসতে ওদের প্রায় ২৫০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। নাইজিরীয় সৈন্যদের পক্ষে এমন অভিযান চালানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন এক পাশ্চাত্য কর্মকর্তা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেশটির পদাতিক বাহিনীর মোট সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এর প্রায় অর্ধৈক উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত। তারপরও আইএস জঙ্গীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গত বছর তিনশরও বেশি সৈন্য নিহত ও দেড় হাজারের মতো আহত হয়। বোকো হারামের সঙ্গে আইএসওয়াপের পার্থক্য হলো প্রথমটি শাসন পরিচালনা নিয়ে মাথাই ঘামাত না। কিন্তু দ্বিতীয়টি সীমান্তের গ্রামগুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর কর বসাচ্ছে। রোড ব্লক বসিয়ে চলাচলরত যানবাহন থেকে অর্থ আদায় করছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মানুষদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, বিচার আচার করছে সোজা কথায় একটা ক্ষুদে খিলাফত তারা গড়ে তুলছে। ওদের এলাকায় গেলে কোন কোন কুটিরে আইএসের কালো পতাকা শোভা পেতে দেখা যাবে। নাইজিরিয়ার জেনারেলরা জঙ্গীবিরোধী লড়াইয়ে জনগণের হৃদয় জয় করার কথা বলছে কিন্তু কাজটা করছে ঠিক তার বিপরীত। সেনাবাহিনী গ্রামাঞ্চল থেকে সুপরিকল্পিতভাবে লোকজন হটিয়ে দিয়েছে, তাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মাইদুগুরি ও অন্যান্য ‘গ্যারিসন শহরে’ গ্রামবাসীদের এনে নোংরা ঘিঞ্জি শিবিরে রেখেছে। নাইজিরিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে লড়াইয়ে প্রায় ২৪ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেনাবাহিনী কর্তৃক এলোপাতাড়ি লোক হত্যা এবং গ্রামবাসীদের জোর করে ‘গ্যারিসন শহরে’ ঢোকানোর ফলে সরকারবিরোধী বিদ্রোহে ইন্ধন জোগানো হচ্ছে। এই ক্যাম্পগুলোতে কোন কাজ নেই, পেশা নেই। অনেক মহিলা ও বালিকা ক্যাম্পগুলোতে ধর্ষিত হয়। গাদাগাদি অবস্থায় আটকা থাকার ফলে হাজার হাজার না হলেও শত শত লোক অনাহারে বা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এই অবস্থাই আবার আইএসওয়াপের অনুকূলে যাচ্ছে। তারা এসব শিবির থেকে লোক রিক্রুট করছে। এক সাহায্যকর্মীর ভাষায় ক্যাম্পগুলো জিহাদী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। ইউএনডিপির মতে আফ্রিকায় জিহাদী গ্রুপগুলোতে যোগদানকারী প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নিষ্ঠুরতার জবাবে জঙ্গী সংগঠনে গেছে। এদের বেশিরভাগ নিরক্ষর এবং গরিব পরিবার থেকে আগত। পশ্চিমা দেশগুলো জঙ্গী মোকাবিলায় আফ্রিকান দেশগুলোকে সাহায্য করছে। নাইজিরিয়ার নেতৃত্বে যে বহুজাতিক বাহিনী গঠিত হয়েছে তাতে তারা অর্থায়ন করছে। আমেরিকা ব্রিটেন নাইজিরীয় বাহিনীকে ট্রেনিং, পরামর্শ ও গোয়েন্দা সার্ভিস দিচ্ছে। ফ্রান্স তো সাহেল অঞ্চলে ব্যাপক অভিযানে নিয়োজিত। তবে এই দেশগুলো নাইজিরিয়ায় আইএস ওয়াপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে চাচ্ছে না যেমনটি তারা এখন করছে সোমালিয়ায়। সোমালিয়ায় তো আমেরিকার শ খানেক সৈন্য আছে এবং তারা সেখানে জিহাদীদের ধরার বা হত্যা করার জন্য অভিযান চালাচ্ছে ও ড্রোন হামলা করছে। নাইজিরিয়া তেমনটা না করার কারণ আপাতত আইএসওয়াপ পাশ্চাত্যের প্রতি তেমন প্রত্যক্ষ হুমকি নয়। তবে আগামীতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের সঙ্গে আফ্রিকায় জিহাদী ভাবধারার উত্থানের তুলনা করা যায়। তবে এই হুমকিকে যথাযথভাবে আমলে না নিলে একটা সময় আসবে যখন পশ্চিমী দেশগুলো প্রত্যক্ষভাবে ও ব্যাপক পরিসরে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। তাই বলে শুধু সামরিক হস্তক্ষেপে যে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না আফগানিস্তানই তার বড় প্রমাণ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×