ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

নীতি আছে, মুদ্রা নেই; মুদ্রা (আমানত) দরকার

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩ আগস্ট ২০১৮

নীতি আছে, মুদ্রা নেই; মুদ্রা (আমানত) দরকার

সময়ের কাজ বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে করতে পারে না- এটা বরাবরের ঘটনা। এবারও তাই হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শুরু হয়েছে পহেলা জুলাই থেকে। এতে সরকারের রাজস্ব নীতি স্থান পেয়েছে। সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে কী করতে চায় তার সবই আছে। এর ভিত্তিতেই মুদ্রানীতি রচনা করা হয়। প্রস্তুতি থাকলে এই নীতি জুলাই মাসের শেষ দিনে ঘোষণা করা হতো না। এই সময়ে ঘোষণা করার ফলে এক মাস চলেই গেল। ছয় মাসের নীতি, অথচ হাতে আছে মাত্র ৫ মাস। এক মাস উধাও। একই কাজ হয় তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশেও। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষ হয়েছে আজ এক মাসের ওপর। যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজের গতি ঠিক থাকে এবং আগের ঐতিহ্য তারা রক্ষা করে তাহলে ডিসেম্বরের দিকে আমরা বার্ষিক রিপোর্ট পেতে পারি- তাও ইংরেজী ভার্সন। বাংলায় প্রতিবেদন করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে হয় ছেড়েই দিচ্ছে। বাংলা ভাষা চালুর সর্বজনীন দাবির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় ব্যর্থতা। ব্যর্থতা তো বরাবর আছে আরেক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধানতম দায়িত্ব উন্নয়নে টাকা যুগিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটা তার আইনী দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে পরিষ্কারভাবে এ কথা বলা আছে। অথচ কোন বছরেই কথামতো, সরকারের টার্গেট মতো তারা মূল্যস্ফীতি ঠিক রাখতে পারে না। একই ঘটনা মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে! আগে এভাবে বছরে দুইবার লোকজন ডেকে মুদ্রানীতি (মানিটারি পলিসি) ঘোষণা করা হতো না। এটা ইদানীংকালের রেওয়াজ করা হয়েছে। বছরে দুইবার, মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়- একবার বাজেট ঘোষণার পর এবং আরেকবার ক্যালেন্ডার বছরের শুরুতে। অনেক লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়, অনেক অঙ্গীকার করা হয়, অনেক সাধু কথা জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকিং খাত যেখানে ছিল সেখানে থাকে না, আরও অধঃপাতে যায়। এটা কোন কথা নয়। পরিসংখ্যানই এ কথা বলে। অথচ এর জন্য কোন জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। ডেপুটি গবর্নর নিয়োগের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। ‘ওপেন কমপিটিশন’। এর জন্য ‘সার্চ কমিটি’ গঠিত হয়। পরে দেখা যায় বাইরের কোন লোক নয় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজনকেই এই পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। মজার ঘটনা গবর্নর পদের জন্য বিজ্ঞাপন নেই। এটা ‘রিজার্ভ’। কার জন্য? অথচ এই প্রধান নির্বাহী পদেই যোগ্যলোক বসানো দরকার। এই পদটিই বিজ্ঞাপিত হওয়া দরকার যাতে যোগ্যলোক কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির হাল ধরে। না, তার কোন ব্যবস্থা নেই। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দিন দিন এই খাতটি রসাতলে যাচ্ছে। এর কিছু উদাহরণ মুদ্রানীতির খবরের সঙ্গেই আছে। যেদিন ঘোষিত মুদ্রানীতির খবর কাগজে ছাপা হয়েছে সেইদিন সাংবাদিকরা অনেক প্রশ্ন করেছেন। ওইসব প্রশ্ন এবং তার জবাব পাঠ করলেই বোঝা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পারফরম্যান্স। গবর্নরকে প্রশ্ন করা হয়েছে টাকা পাচার সম্পর্কে তিনি এর উত্তর না দিয়ে উল্টো সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করছেনÑ ‘টাকা পাচারের অনেক ঘটনা হয়েছে নাকি’। একটি কাগজ তার খবরের শিরোনামে এ কথা প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে টাকা পাচারের ওপর করা প্রতিবেদন সম্পর্কে তিনি জানেনই না। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ‘ব্যাংক মালিকরা যেভাবে সুদহার নির্ধারণ করে দিচ্ছে, এটা কি তারা পারে?’ জবাবে গবর্নর ফজলে কবীর বলেন,‘সুদহার তারা ঠিক করতেই পারে’। অথচ সারাদেশে এই কর্মটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। একযোগে সবাই বলছে, এটা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটা কাজ। দেশে ‘প্রতিযোগিতা কমিশন’ রয়েছে। তা আইনের বিরোধী কাজ। সকল ব্যাংকের মালিকরা ‘বোর্ডের’ বাইরে বসে একযোগে আমাদের সুদের হার, ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে দিতে পারেন না। পারেন না বলতে প্রধান নির্বাহীদের চাকরি যাবে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে না আনলে। প্রতিযোগিতা বিরোধী, বাজার অর্থনীতির নিয়মবিরোধী এই কাজ কি করে গবর্নর সাহেব সমর্থন করলেন তা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। এসব কথা আর বাড়াতে চাই না, অথচ এগুলো না বললে মুদ্রানীতির ওপর আলোচনা করে লাভ নেই। মুদ্রানীতি কতগুলো পরিসংখ্যান নয়, নয় কতগুলো লক্ষ্যমাত্রা এবং অভিলাষ। মুদ্রানীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তব অবস্থা। বাস্তব অবস্থা কি? এই মুহূর্তে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে আমানতের (ডিপোজিট) অভাব যাকে বলা হয় তারল্য সঙ্কট। ডিপোজিট বা আমানতই তো ‘মানি’। মুদ্রানীতি তো শুরু হবে ‘মানি’ দিয়ে অর্থাৎ আমানত দিয়ে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ‘মানি’ বা মুদ্রার যে সংজ্ঞা ব্যবহার করে তা শুরু হয় ‘ক্যাশ উইথ দ্য পাবলিক দিয়ে’ যাকে বলা হয় ‘কারেন্সি আউট সাইড ব্যাংকস’। তার সঙ্গেই যোগ হয় ‘ডিমান্ড ডিপোজিট’ (তলবি আমানত)। এই দুইয়ে মিলে হয় ‘ন্যারো মানি’ বা এম-১। এর সঙ্গে মেয়াদী আমানত (টাইম ডিপোজিট) যোগ করলেই পাওয়া যায় ‘ব্রডমানি’ বা এম-২। দেখা যাচ্ছে- ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বলা হচ্ছে এই ‘ব্রডমানি’ বাড়বে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়বে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বাড়বে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়বে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। লক্ষণীয়, সরকারী খাতের ঋণ বাড়বে প্রায় দুই শতাংশ বেশি গেল ষাণ¥াসিকের তুলনায়। অন্যদিকে বেসরকারী ঋণের কোন প্রবৃদ্ধি নেই। গেল ছয় মাসে যে হারে তা বৃদ্ধি পেয়েছে আগামী ছয় মাসেও সেই হারে তা বৃদ্ধি পাবে। প্রসঙ্গক্রমে বাণিজ্য ঘাটতির কথা এসেছে যা এযাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটিই শুধু সর্বোচ্চ নয়, সর্বোচ্চ ঘাটতি ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্টে’ এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। সাংবাদিক সম্মেলনে আরও বলা হয়েছে, বিগত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এই অর্থবছরেও সরকারী ঋণপত্র ভীষণভাবে বাড়বে এবং তা বাড়বে অবকাঠামোর প্রয়োজনে খোলা ঋণপত্রের জন্য। অতএব সরকারী ঋণ বাড়বে। আমদানি সূত্রে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। চাপ বাড়বে ডলারের দামের ওপর, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর। এই সূত্রে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, এসব মাথায় রেখেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা তো অন্যত্র জন্ম হচ্ছে। যেদিন মুদ্রানীতির খবর ছাপা হয়েছে সেইদিনই একটি অর্থনৈতিক দৈনিকে দেখলাম খুবই বড় দুশ্চিন্তার খবর। খবরটির শিরোনাম: ‘স্ট্রেস টেস্টিং রিপোর্ট, শীর্ষ ৩ গ্রাহক খেলাপী হলে ঝুঁকিতে পড়বে ১৯ ব্যাংক।’ এই ১৯টি ব্যাংকের মধ্যে যেমন আছে সরকারী ব্যাংক, তেমনি আছে বেসরকারী ব্যাংক। আবার দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ৯টি ব্যাংকে আছে মূলধন সঙ্কট। খবরটিতে বলা হয়েছে এই ঘটনা ঘটলে ব্যাংকিং খাত পড়বে তারল্য সঙ্কটে। প্রার্থনা করি এটা যাতে না ঘটে। আমার প্রশ্ন অন্যত্র। এই যে ৫৭টি ঋণগ্রাহক ১৯টি ব্যাংককে বিপদে ফেলতে পারে তারা তো একদিনে বড় বড় ঋণগ্রাহক হয়নি। এমন কী তারা ৫-৭-১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংকঋণ নিয়েছে তারাও একদিনে তা নেয়নি। ‘লার্জ লোনের’ সীমা থাকার পরও এত বড় বড় গ্রাহক হয়েছে যাদের অধিকাংশই ‘ওভার বরোড মানি’। বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর তার নীতির মাধ্যমে বড় বড় লোন পরিহার করার কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হচ্ছে বড় বড় লোন ধীরে ধীরে গলার ফাঁস হচ্ছে। চট্টগ্রামের গ্রাহকরা ব্যাংকের গলার ফাঁস হচ্ছে। ‘ট্রাস্ট রিসিটের’ (টিআর) বিপরীতে ঋণ গ্রহীতারা গলার ফাঁস হচ্ছে ব্যাংকগুলোর। এমতাবস্থায় তো একটা প্রশ্ন করতেই পারা যায়। মুদ্রানীতি দিয়ে কি হবে? কতগুলো পরিসংখ্যান জাতির সামনে পেশ করে কি হবে? বিশেষ করে যখন ‘মানি’ নিয়েই সমস্যা। ‘মানি’ নেই বাজারে। ‘মানি’ মানে আমানত (ডিপোজিট)। ‘মানি’ ছাড়া মনিটরিং পলিসি দিয়ে কী হবে? ‘মুদ্রা’ নেই, মুদ্রানীতি থাকবে- এই তো হচ্ছে অবস্থা। এখন কী করা যায়? তারল্য বা আমানত দরকার সর্বাগ্রে। এর বারোটা বাজিয়েছে অবিবেচক ব্যাংকার এবং ব্যাংকমালিকরা। আমানতের ওপর সুদের হার নিয়ে বার বার ‘কারিগরি’ করে তারা এর বাজারটাকে অস্থিতিশীল করেছে। সর্বশেষ করেছে ‘নয়-ছয়’ এর মাধ্যমে। ঋণের ওপর সুদের হার ৯ শতাংশ করতে হবে। কেউ দেখলই না সরকারী ব্যাংকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতের অনেক ঋণের ওপর সুদের হার আগে থেকেই ৯ শতাংশ অথবা তার নিচে। অথচ একটা হুজুগ তুলে সঙ্কট তৈরি করা হলো। ফাঁকে দিয়ে আমানতের ওপর সুদের হার অনেক ব্যাংক কমিয়ে ফেলেছে। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, নয়-ছয় নীতি কেউ মেনেছে, কেউ মানেনি। ব্যাংকমালিকরা দেখলাম আবার তদবির করছে সরকারের সঙ্গে সরকারী ফান্ডের জন্য। সরকার যেন সার্কুলার দেয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন সার্কুলার দেয়। কেন? ছয় শতাংশে আমানত রাখতে। আমি বুঝি না একটা জিনিস। দেশের মোট আমানতের মধ্যে ৮০-৮৫ শতাংশই বেসরকারী খাতের আমানত। বাকিটা সরকারী। ১৫ শতাংশ আমানতের জন্য তারা সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। অথচ ৮৫ শতাংশ আমানত বেসরকারী খাতে। কেন তারা ওই খাতে যাচ্ছে না আমানত সংগ্রহের জন্য। ৩০-৩৫ বছর বেসরকারী ব্যাংকিং করার পর এই হচ্ছে অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বলি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তবে অবশ্যই মুদ্রানীতি ঘোষণার পাশাপাশি। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×