ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অপুষ্টি ও রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে দেশের ৬০ ভাগ কিশোরী

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৩ আগস্ট ২০১৮

অপুষ্টি ও রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে দেশের ৬০ ভাগ কিশোরী

নিখিল মানখিন ॥ দেশের ৬০ ভাগ কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। তাদের মধ্যে ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪৩ ভাগ কিশোর-কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। তাদের প্রায় ৫ ভাগ কিশোর-কিশোরীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রামের কম। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্যজ্ঞান খুবই সামান্য। এতে নানা ঝুঁকির মধ্যে বেড়ে উঠছে কিশোর-কিশোরীরা, যা পরবর্তীতে মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক জনকণ্ঠকে জানান, দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশ কিশোর-কিশোরী। তাদের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন। শুধু তাদের স্বাস্থ্য সমস্যার দিকটি বিবেচনা করলেই হবে না, অন্যান্য সমস্যার বিষয়টিও সমাধানের বিবেচনায় আনতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ ভাগের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লাখ। অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, যাদের শতকরা ৭৬ ভাগ গ্রামে এবং ২৪ ভাগ শহর এলাকায় থাকে। দেশের কিশোর-কিশোরীরা উপযুক্ত শিক্ষার অভাব এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুযোগের কারণে নানা ঝুঁকির মধ্যে বেড়ে উঠছে। এছাড়া তারা দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য ও সেবার অপ্রতুলতা, অনিরাপদ পরিবেশসহ নানাবিধ প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এসব প্রতিন্ধকতা তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক চাহিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় তাদের জীবন রক্ষাকরাসহ বয়োসন্ধিক্ষণের সময়ে যথাযথ দিকনিদের্শনা দিতে পারে না। তাদের সার্বিক উন্নয়নে সঠিকভাবে সাহায্যও করতে পারে না। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৪১ ভাগ মহিলা অপুষ্টির শিকার এবং ৬০ ভাগ কিশোরী অপুষ্টি ও রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। যার মধ্যে ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪৩ ভাগ কিশোর-কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে এবং এদের প্রায় ৫ ভাগ কিশোর-কিশোরীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রামের কম। দেশের কিশোর-কিশোরীর শতকরা ৪৩ জনের আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে এবং এর অভাবে স্নায়ুতন্ত্রের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। শতকরা ৬০ ভাগ কিশোরী অপুষ্টি ও এ্যানেমিয়ার শিকার। আবার ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর শতকরা ৪৩ভাগ এ্যানেমিয়ায় ভোগে এবং তার বাইরে প্রায় ৫ ভাগ কিশোর-কিশোরীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রামেরও কম। এভাবেই দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসাবে কিশোর-কিশোরীর জীবন ক্রমাগত অপুষ্টির দুষ্টচক্রে নিপতিত হয়। ফলে অপুষ্টি নিয়ে গড়ে ওঠা একটি মেয়ে যখন গর্ভবর্তী হয় তখন জন্ম দেয় অপুষ্টি ও কম ওজনের একটি শিশু। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, দেশে কিশোর-কিশোরীর মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান খুবই সামান্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর জানায়, এদেশের ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মহিলার গড়পড়তা বিয়ের বয়স ১৬ বছর। এখানে ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই এক-তৃতীয়াংশ মহিলা মা হয়ে যায়। যদিও ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ মায়ের ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্যান বাংলাদেশের সমীক্ষা থেকে পাওয়া গেছে, দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী সহিংসতা, গর্ভধারণ জটিলতা ও বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে মারা যায়। পারিবারিক সহিংসতা বয়োপ্রাপ্ত মেয়েদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ হুমকি হয়ে দেখা দেয়। পারিবারিক সহিংসতার কারণে ১৩ থেকে ১৮ বছরের যুবা গৃহবধূ ও মেয়ের শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মারাত্মক শারীরিক আঘাতে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে থাকে। এছাড়া এসিড সন্ত্রাস, ইভ টিজিং, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় দেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিশোর-কিশোরী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, শতকরা ৭০ ভাগ মহিলা ও কিশোরী এবং ৩২ ভাগ পুরুষ ও কিশোর এসিড সন্ত্রাসে আক্রান্ত এবং এদের অধিকাংশের বয়স ১৮’র নিচে। বাংলাদেশ এ্যাডোলেসেন্ট হেলথ কান্ট্রি প্রোফাইল, ড্রাফট : ইউনিসেফ সূত্র জানায়, দেশে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার ৬০ ভাগ শিকার হয় কিশোরী এবং এদের যৌন আক্রমণের শিকার হওয়ার গড় বয়স সাড়ে ১১ বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে নতুন ও ভিন্নতর স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়। এসব সমস্যা আবেগ, আচরণ এবং যৌন আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন কিশোর বা কিশোরীর শারীরিক, বোধ, আবেগ, সমাজ ও অর্থনীতিসম্পর্কিত অর্জন পরবর্তী জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। তাই এদের স্বাস্থ্য চাহিদা আড়াল করা ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) বিজ্ঞানী ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কামরুন নাহার বলেন, কিশোর-কিশোরীর নানা বিষয়ে আগ্রহ থাকে। অনেক সময় তারা ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না। তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। এই বয়সে স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে স্বাস্থ্যতথ্য বেশি প্রয়োজন বলে জানান কামরুন নাহার।
×