ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি খায়রুল হকের অভিমত

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৩ আগস্ট ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন

বিকাশ দত্ত ॥ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বৃহস্পতিবার বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অপরাধের মাত্রা ও প্রকৃতি অনুসারে শাস্তির বিধান অবশ্যই বাড়ানো উচিত। এই ক্ষেত্রে অন্তত প্রতিরোধক (উবঃবৎৎবহঃ) ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। নতুন আইন সব সময় ওয়েলকাম করি। সারাবিশ্বের আলোকে আমরা আধুনিক ও যুগোপযোগী আইন করার পক্ষে। ঞযব গড়ঃড়ৎ ঠবযরপষবং ঙৎফরহধহপব ১৯৮৩ ও ২০০৮ সালের ১০ মার্চ স্যুয়োমটো রুলের আলোকে তদানিন্তন সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ হলফনামা দিয়ে যে দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। বৃহস্পতিবার তিনি জনকণ্ঠকে এ কথা বলেছেন। এর আগে বুধবার আইনমন্ত্রী বলেছেন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ হবে অত্যন্ত আধুনিক। তার কারণ হচ্ছে এই আইনে অনেক বিষয় আছে যা আগের কোন আইনে সমাধান হয়নি। আইনটা মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হবে, প্রধানমন্ত্রী চান এটা তড়িৎ উপস্থাপিত হোক। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় এই আইনটা যদি অনুমোদিত ও সংসদে পাস হয় তাহলে সব স্টেকহোল্ডার ন্যায়বিচার পাবেন। গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়ে। বৃহস্পতিবারও পঞ্চম দিনের মতো সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ ঘটনায় সম্প্রতি ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধে রুলসহ বাসচাপায় শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও আব্দুল করিমের নিহতের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে দিয়েছে হাইকোর্ট। আদালত তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণেরও নির্দেশ দিয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের ১০ মার্চ বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং বিচারপতি আব্দুল আউয়ালের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ সড়ক দুর্ঘটনায় একটি যুগান্তকারী স্যুয়োমটো রুল জারি করেন। ঐ রুলে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্তি ব্যতিরেকে কোন প্রকার মোটরযান ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া গাড়িতে গতি নিয়ন্ত্রক সিল সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন ২০০ টাকা জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া যে তারিখ হতে গতি নিয়ন্ত্রক ব্যতিরেকে অথবা বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত গতি নিয়ন্ত্রক পরিলক্ষিত হবে সেই তারিখ হতে প্রথম প্রতিদিনের জন্য ২০০ টাকা এবং প্রথমবারের শাস্তি প্রাপ্তির পর প্রতিদিনের জন্য ৪০০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্যুয়োমটো রুলটি বাধ্যতামূলক। বিবাদীগণ এফিডেভিট দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রক সংযুক্তি করার বিষয়টি স্বীকার করেছিল । কিন্ত পরে তা আর করা হয়নি। তারা মামলাটিতে কনটেস্ট করেছিল। এ মামলার ঘটনায় জানা যায়, একটি পত্রিকায় ‘অকালেই ঝরে গেল সুচি’ শিরোনামে একটি তরুণীর মৃত্যু সংবাদ ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদে বর্ণনা করা হয়, সাদিয়া আফরিন সুচি নামে এক তরুণী ১১-১২-২০১৭ তারিখে দিন ঢাকা সিটি কলেজে পরীক্ষা শেষে তার দুই সহপাঠির হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল । ঠিক তখনই ৫ ও ৬ নম্বর সড়কের মাঝ বরাবর একটি দ্রুতগামী বাস এসে পেছন দিক হতে তাকে চাপা দেয়। তাজা রক্তে রাজপথ ভেসে যায়। তরুণীকে তড়িৎগতিতে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাটি দেখে আদালত স্যুয়োমটো রুল জারি করে। ওই রুলে বলা হয়, মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স ৮৫ ধারার প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য ১০-৩-২০০৯ তারিখের পর হতে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্তি ব্যতিরেকে কোন প্রকার মোটরযান ক্রয়বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। প্রতিবাদীগণ এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ তড়িৎ গ্রহণ করবেন। উপরোক্ত আইনের বিধান প্রয়োগার্থে তফসিলে বর্ণিত গতিসীমা অনুসারে সকল মোটরযানের গতি সীমিত রাখার জন্য প্রতিবাদীগণকে তড়িৎ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশে ব্যবহৃত সকল প্রকার মোটরযানে গড়ঃড়ৎ ঠবযরপষবং ঙৎফরহধহপব ১৯৮৩ এর ৮৫ ধারা এবং এর আওতায় প্রণীত অষ্টম তফসিল অনুসারে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হলো। ওই আইন যথোপযুক্ত ও কার্যকরভাবে প্রয়োগার্থে প্রতিটি মোটরযানে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে উপরোক্ত আইনের মূল বাণী অনুসারে গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তড়িৎ গ্রহণের জন্য প্রতিবাদীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তার রায়ে আরও বলেন, এই নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিবাদীগণ ও কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ব্যবহৃত সকল প্রকার পাবলিক ও প্রাইভেট সকল প্রকার মোটরযানে আগামী ১০-৩-২০০৯ তারিখের মধ্যে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি মারফত জনসাধারণকে জ্ঞাত করবেন। এবং অন্তত ঐ তারিখ হতে উক্ত বিধান অমান্যকারী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া উপরোক্ত ৮৫ ধারার প্রয়োগ নিশ্চিত করণার্থে ১০-৩-২০০৯ তারিখের পর হতে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্তি ব্যতিরেকে কোন প্রকার মোটরযান ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। প্রতিবাদীগণ এই ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ ত্বরিত গ্রহণ করবে। রায় ঘোষণায় আরও বলা হয়, এক নম্বর প্রতিবাদী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের পক্ষে ২৭-২-২০০৮ তারিখে হলফকৃত এফিডেভিটে বর্ণনা করা হয় যে, ঞযব গড়ঃড়ৎ ঠবযরপষবং ঙৎফরহধহপব ১৯৮৩ এর ৮৫ ধারায় নির্দেশিত গতিসীমার মধ্যে মোট যানবাহনের গতি সীমিত রাখার বিধান রয়েছে অন্যথায় ১৪২ ধারা অনুয়ায়ী শাস্তিরও বিধান রয়েছে। বিধায় রুলটির প্রতিবন্ধকতা করার অবকাশ নেই। ওই এফিডেভিটে আরও বর্ণনা করা হয় যে, এই আইনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ মোটর ভিহিকলস রুলস এর আওতায় যানবাহনে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ ব্যবহার এবং আইনের বিধান বাস্তবায়ন করতে আইনগতভাবে বাধ্য। ওই এফিডেভিটে আরও বর্ণনা করা হয় যে, বিআরটিএ প্রত্যেক মোটরযানের ফিটনেস সনদ প্রদানের সময় ইঞ্জিনে গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্ত করতে পারে যা সংশ্লিষ্ট মোটরযান টি র্নির্ধারিত গতিবেগের উর্ধে না চলতে পারে। এই প্রতিবাদী পক্ষে স্যুয়োমটো রুলটি স্বপক্ষে বক্তব্য রাখা হয়। ৩নং প্রতিবাদী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পক্ষে ৭-২-২০০৮ তারিখে হলফকৃত এফিডেভিট প্রদান করে রুলটি জারির পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ওই এফিডেভিটে ঞযব গড়ঃড়ৎ ঠবযরপষবং ঙৎফরহধহপব১৯৮৩ এবং গড়ঃড়ৎ ঠবযরপষবং জঁষবং এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক প্রত্যেকটি মোটর যানবাহনে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্তকরণ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক স্বীকার করে নেন। এবং এফিডেভিটে বর্ণনা করেন যে সংশ্ল্ষ্টি বিধি ও বিধানানুসারে প্রত্যেকটি যানবাহনে ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান করার সময় এরূপ ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্ত করার প্রতিবিধান তারা করবেন। ৪নং প্রতিবাদী মহা পুলিশ পরিদর্শকের পক্ষে ২৭-২-২০০৮ তারিখে হলফকৃত একটি এফিডেভিট মারফৎ অত্র রুলটি বাস্তবায়ন পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। ওই এফিডেভিটে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ প্রত্যেকটি যানবাহনে সংযুক্ত রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে তাদের দায়িত্ব স্বীকার করে ভবিষ্যতে তারা এই আইন বাস্তবায়ন করার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তা বর্ণনা করা হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়, গতি নিয়ন্ত্রক বা ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সরকার কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি মারফৎ এবং সর্বশেষ ১০-৩-২০০৯ তারিখ এর মধ্যে সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন ২০০ টাকা জরিমানা করা হবে। তা ছাড়া যে তারিখ হতে গতি নিয়ন্ত্রক ব্যতিরেকে অথবা বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ গতি নিয়ন্ত্রক পরিলক্ষিত হবে ১০-৩-২০০৯ তারিখ হতে প্রথম প্রতিদিনের জন্য ২০০ টাকা এবং প্রথমবারের শাস্তি প্রাপ্তির পর প্রতিদিনের জন্য ৪০০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করা হবে। সংশ্লিষ্ট মামলার এ্যাটর্নি জেনারেল ড. নাঈমা হায়দার (বর্তমানে বিচারপতি) আদালতে বলেন, জনসাধারণের জন্য ব্যবহৃত যে কোন মোটর চালিত যানবাহনে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্ত করার বিধান বহু পূর্বে থেকেই রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও তিনি স্বীকার করেন যে ওই আইনের সংশ্লিষ্ট বিধিগুলো নানা প্রকার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ হলফনামা দাখিল করে বলেন, প্রত্যেকটি মোটরযানে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ সংযুক্ত করার যৌক্তিকতা উত্থাপন করে আরও অনেক পদক্ষেপ নেবার জন্য নিবেদন করেন। যার মধ্যে বিভিন্ন মহাসড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন, রাস্তার বিভিন্নস্থানে সিগন্যালিং ব্যবস্থা উন্নীতকরণ, বিপরীত দিক হতে আগত যানবাহন দেখার জন্য বিশাল আকারের আয়না স্থাপন ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন। রায়ে বলা হয়, অধ্যাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট বিধি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, বহু পূর্ব থেকেই সকল প্রকার মোটরযানবাহনের গতি সীমিত রাখার লক্ষ্যে ইজ্ঞিনের সঙ্গে ঝঢ়ববফ এড়াবৎহড়ৎ ঝবধষ গতিনিয়ন্ত্রক সংযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে ওই আইন বাস্তবায়ন করার জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, স্ব-উদ্যোগে জারিকৃত অত্র রুলটা আদালতের সাংবিধানিক দায়িত্ব হতে জারি করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবে এই শপথ গ্রহণ করায় সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিগণ তাদের ওপর ন্যস্ত শুধু বিচারিক কার্যাবলী সুসম্পন্নই করবে না বরঞ্চ বাংলাদেশের আইন ও আইনের বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কোন নজির তাদের সম্মুখে এলে সে সম্বন্ধে যথাবিহীত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বা নির্দেশ প্রদান করতে তারা সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হতেই স্ব উদ্যোগে রুলটি জারি করা হয়েছে।
×