ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির বাউল উৎসব

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২ আগস্ট ২০১৮

সম্প্রীতির বাউল উৎসব

শ্রাবণের গোধূলি লগ্ন। আকাশজুড়ে মেঘের আনাগোনা। ভরা বর্ষায় পাখিদের নীড়ে ফেরার তাড়া। আলো আঁধারী ধুয়াশার মধ্যে ছিটছিট বারিপাত। মৎস্য ভবনের মোড় থেকেই শোনা গেল মাটির গানের সুর। শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বসেছিল বাউলদের মিলন মেলা। দু’বাংলার বাউল শিল্পীদের নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির সহযোগীতায় লালন গবেষক আবদেল মান্নান আয়োজন করেছিলেন ২৬-২৮ জুলাই ৩ দিনব্যাপী বাউল সঙ্গীত উৎসব। ‘মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে, সে কি অন্য তত্ত্বমানে ॥’ এই ভাব দর্শনকে সামনে রেখেই উৎসবের চলা। বঙ্গদেশে বাউল শব্দটি খুবই পরিচিত। এর সঙ্গে রয়েছে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, রয়েছে শেকড়ের অস্তিত্ব। বাউলকে নির্মাণ করতে হবে আস্বাদনের মধ্য দিয়ে। লেখালেখি বা গবেষণায় বাউলকে পাওয়া যাবে না। ইনারা সমাজে মৃতকল্প হয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই জীবন্মুক্ত অবস্থাকে সুফি সাধকেরা বলেন ‘ফানা’ আর বৈষ্ণব সাধকেরা বলেন ‘প্রাপ্ত ব্রহ্মালয়।’ তাদের মতে প্রেম কামনা শূন্য না হলে কামপূর্ণ প্রেমের দ্বারা মুক্তি লাভের সম্ভাবনা নেই। তাই বাউল সম্প্রদায় ইহজাগতিক বন্ধন ভুলে দেহতত্ত্বে মনোনিবেশ করেছেন। নিজেকে সৃষ্টি করার প্রবল আকাক্সক্ষায় ছুটে চলেন। তাদের ধারণা দেহের মধ্যে সুপ্ত শক্তিসমূহকে আয়ত্ত করতে পারলেই ঐশ্বর্য লাভ সম্ভব। সেই সঙ্গে আবার বলেছেন, প্রকৃতি থেকে যে আনন্দ লাভ সম্ভব সেটাই প্রকৃত আনন্দ। তাই তো বাউল গেয়ে ওঠেÑ জীবে জীবে চাইয়া দেখি সবই যে তাঁর অবতার। নতুন লীলা কি দেখাবি, যার নিত্য লীলা চমৎকার ॥ দেহ মন্দিরে বাস করে মানুষের মনের মানুষ। এই মনের মানুষকে সন্ধান করাই বাউলদের সাধনা। বাউল তাই প্রচার করেন সম্প্রীতির বাণী। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে চমৎকার এক মানবিক সমাজ গঠনে বাউল সম্প্রদায় বদ্ধপরিকর। তাদের ভাবদর্শন শুধু জীবন প্রেমের মহিমাই প্রকাশ করে। চ-ীদাস তাঁর বাণীতে বলেছেনÑ মানুষ মানুষ সবাই কহয়ে, মানুষ কেমন জন। মানুষ রতন মানুষ জীবন, মানুষ পরম ধন ॥ আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ প্রীতিই দুর্লভ বস্তুতে পরিণত। মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তপাত। পুঁজিবাদ, পেশীশক্তি সেই সঙ্গে নানা রকমের মারণাস্ত্রের উদ্ভাবন সব কিছুই যেন মানুষ ধ্বংসের। প্রবংশের কাছে জবাব দিতে হলে ফিরতে হবে সেই বাউলের কাছে। যেতে হবে শেকড় সন্ধানে। বাউলরা বলেন, যাহা সহজ তাহাই ধর্ম, তাহাই উপাস্য। প্রতিমা, ঠাকুর প্রভৃতি কোন প্রতীকেরই আবশ্যক নাই, ওই মনের মানুষই মানুষের উপাস্য। তাঁহাকেই চিনিতে হইবে। ‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্য জ্ঞানে।’ এই দিব্য জ্ঞানই হচ্ছে মানুষের বিবেক। শ্রেণী সংগ্রাম বা জাতিগত অস্থিরতার গোড়াপত্তন ঘটেছে বহু পূর্বেই। মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। তাই তো লালন দর্শন বলেÑ এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।। এই গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট বাউল শিল্পী শফি মন্ডল বলেন, ‘অনুষ্ঠানের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও এ ধরনের উদ্যোগ নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। এদেশে যখন জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছিল তখন বাউলরা একটা সংকটে পড়েছিল সত্য, তবে এখন বাউল চর্চা বেশ ভালভাবে এগোচ্ছে। শিক্ষিত তরুনরা বাউল সঙ্গীত চর্চা করছে। লালন এখন সাহিত্যে জায়গা পেয়েছে। লালন একাডেমিতে লালন সাহিত্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ানো হচ্ছে।’ বাউল দর্শন মূলত উদার ও অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে প্রসারমান। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাঁরা ছিলেন স্বশিক্ষিত। মানবিকতার চরম শিখড়ে তাদের বসবাস। অব্যবস্থাপনার উৎসবের বিশেষ আকর্ষন তরুন বাউল শিল্পি সালমা ও বিউটির গান করার কথা থাকলেও তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল না। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সালমা বলেন,‘ আমি অনুষ্ঠানের বিষয়ে কিছুই জানিনা’। বরং ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন ‘আমাকে না জানিয়ে আমার নাম আমন্ত্রন পত্রে দেওয়া হয়েছে। তবে আমি জানলে অবশ্যই আসতাম।’ আবদেল মান্নান দ্বায় স্বীকার করে বলেন,‘ তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্ঠা করে পাইনি। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে অনুষ্ঠানে কিছু অব্যবস্থাপনা হয়েছে’। তিনদিনব্যপী উৎসবে শফি মন্ডল ছাড়াও গান পরিবেশন করেন টুনটুন বাউল, রহিম ফকির, ভারতের সঞ্জয় কীর্তুনিয়া, বন্যাশ্রীসহ ভারত বাংলাদেশের শতাধিক বাউল। নদী ভাঙ্গনের এই দেশে বাউলদের জীবনাচার সব সময়ই কিছুটা কন্টকাকীর্ণ ছিল। নানাবিধ ফতোয়া বা সমাজচ্যুতির খড়গ প্রায়শই উঠত তাদের মাথার ওপর। বিত্তবানেরা যেভাবে সমাজ সংসারকে অস্থির করে তুলেছে তাদের সেই মিথ্যা অহমিকার অপঘাত হতে নিজেদের আগলে রাখার ক্ষমতা বাউলদের ছিল এবং আছে। তাইতো লালন ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, শুনি মরিলে পাব বেহেস্তখানা, তা শুনে তো মন মানে না। বাকির লোভে নগদ পাওনা, কে ছাড়ে এই ভূবনে।।
×