ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব...

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২ আগস্ট ২০১৮

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব...

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে অনন্য এক নাম ফিরোজা বেগম। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি নজরুল সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তিনি বাংলা সঙ্গীতের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচ্য। সঙ্গীতের সকল ক্ষেত্রে তার ছিল সমান পদচারণা। তবে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন নজরুল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। নিজে নজরুলের কাছে গান শিখেছেন, তাকে গান শুনিয়েছেন। নজরুল তার গানের মুগ্ধশ্রোতা ছিলেন, এমনকি যখন কবি ভীষণ অসুস্থ, বোধশক্তিহীন, তখনও ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে নিজের লেখা গান শুনলে কবির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। এ এক অনবদ্য সৃষ্টি সুখের উল্লাস। গত আজ ২৮ জুলাই ছিল বাঙালীর এই কিংবদন্তিতুল্য সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের ৮৮তম জন্মদিন। তার জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে গত শনিবার নতুন একটি ডুডল প্রকাশ করেছে গুগল। গত শনিবার সার্চ ইঞ্জিন গুগলের পেজ খুললেই দেখা যাচ্ছে শাড়ি, গলায় বড় মালা আর খোপা করা চুলে নজরুল সঙ্গীত স¤্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগমকে। ডুডলটিতে ক্লিক করলেই ফিরোজার জীবন ও কর্মের ওপর নানা ওয়েবসাইট সামনে এনে দিচ্ছে গুগল। জন্মদিনের প্রথম প্রহর থেকেই সার্চ ওয়েবটি নিজেদের হোমপেজে দেখা গেছে। ফিরোজা বেগমকে নিয়ে ডুডলটি তৈরি করেছেন অলিভিয়া হুন। সময়টা ত্রিশের দশক। ব্রিটিশ-ভারত। চারদিকে আন্দোলনের আগুন দিগি¦দিক জ্বলছে। বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও তা দাবানলে রূপ নিলেও ইংরেজ সাম্রাজ্যের পতনের অশনি সঙ্কেত তখনও বাজেনি। ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার। সেই বাড়িতে স্থানীয় ব্রিটিশ অফিসার কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের নিত্য আনাগোনা। গল্পগুজব, শলাপরামর্শে পার হয় অখণ্ড সময়। ভেতর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসে চা-জলখাবার। অভিজাত ওই পরিবারে এমন দৃশ্যই তো স্বাভাবিক। পরিবার প্রধান খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল ব্রিটিশ সরকারের কৌঁসুলি। তিনিই প্রথম মুসলমান সরকারী কৌঁসুলি। খান বাহাদুর সাহেবের স্ত্রী সুগৃহিণী বেগম কওকাবুন্নেসা। এই দম্পতির তিন ছেলে, চার মেয়ে। সবাই যে যার পৃথিবীতে ব্যস্ত। দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে- ফিরছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, খেলাধুলা করছে। সাঁঝ হলে পড়তে বসছে। বাবা কিংবা মায়ের অতটা অবসর নেই সবার প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেয়ার। এঁদের তৃতীয় কন্যাটি আবার একটু অন্যরকম। ওঁর জন্ম ১২ শ্রাবণ, ২৮ জুলাই, এক পূর্ণিমার রাতে। তখন কেই বা ভেবেছিল এ মেয়ে একদিন সঙ্গীতাকাশে জাজ্বল্যমান চন্দ্রিমা হয়ে বিরাজমান থাকবে। মূল নাম ফিরোজা বেগম হলেও শ্রাবণে জন্ম বলে আদর করে কেউ কেউ তাঁকে শ্রাবণী বলে ডাকতেন। আবার ফর্সা টুকটুকে বলে কেউবা ডাকতেন আনার নামে। তিনি ছিলেন বরাবরই অন্তর্মুখী স্বভাবের কিন্তু প্রচণ্ড মেধাবী। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম আকাশ বাণী রেডিওতে গান গেয়েছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে তৎকালীন খ্যাতিমান সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান এইচএমভি থেকে বের হয় তার প্রথম গানের রেকর্ড। এইচএমভির রিহার্সেলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত হয়। প্রথম সাক্ষাতেই কবিকে তিনি গেয়ে শুনিয়েছিলেন- ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’। ১১-১২ বছরের ফিরোজার কণ্ঠে ওই গান শুনে নজরুল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। জীবনের বাকিটা সময় ফিরোজা, নজরুলের গানকেই পরম মমতায় আঁকড়ে রেখেছিলেন। ফিরোজা বেগম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৮০টিরও বেশি একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। মুসলিম নারীরা যখন ঘর থেকেই বের হতে পারতেন না; পর্দার আড়ালেই জীবন কাটিয়ে দিতেন, ঠিক সে সময় সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারের কন্যা হয়েও সঙ্গীতের ব্যাপারে কখনও আপোস করেননি সুরের এই স¤্রাজ্ঞী। নজরুল সঙ্গীত ছাড়াও তিনি আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। জীবদ্দশায় তার ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালীন ১৯৫৫ সালে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। বিখ্যাত গান- ‘ওরে শুভ্রবাসনা রজনীগন্ধা’। কমল দাশগুপ্ত ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। এ দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে– তাহসিন, হামীন ও শাফীন। হামিন ও শাফিন রকব্যান্ড দল মাইলসের সদস্য। ১৯৬৮ সালে তার গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’র রেকর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে দু’লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এ জন্য জাপানের সনি কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিবিএস তাকে গোল্ড ডিক্স দিয়ে সম্মানিত করে। বলা হয়ে থাকে, ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা থেকেই নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে ঢাকা রেডিও ও ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন হয়, তার গাওয়া গানের মধ্য দিয়েই। সঙ্গীত অঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফিরোজা বেগম নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার, সেরা নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পুরস্কার (একাধিকবার), শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশে), নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল বাংলাদেশের বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘বঙ্গ সম্মান’য় ভূষিত হন। নিয়মিত কবিতা পড়াতেন ফিরোজা বেগম। বাগান করতেন। এ দুটোও তার ক্যানভাস ছিল। নিয়ম করেই রেওয়াজ করতেন এই সুর-তাপসী। আরও ছিল কিছু পাখি। তাদের কলকাকলী, নজরুলের গান, হৃদয়পাত্র উছলে পড়া মাধুরীময় স্মৃতিরাজিই ছিল তাঁর শেষ দিনগুলোর নিত্য সহচর। কিডনি জটিলতায় ভুগে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে চিরতরে নিভে যায় সঙ্গীত জগতের এই পুরোধা ব্যক্তির প্রাণ। কিন্তু তার সেই গানের মতোই তিনি জ্বলজ্বল করে আছেন অগণিত ভক্ত, সঙ্গীতপ্রেমী, পরিবার এবং শুভাকাক্সক্ষীর হৃদয়ের গভীরে- ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’
×