ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তারা যদি রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে দেখতে পেতেন -আজিজুর রহমান

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২ আগস্ট ২০১৮

তারা যদি রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে দেখতে পেতেন -আজিজুর রহমান

রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করে দিগন্ত দেখেন তিনি। রং দেখেন, বড়কে দেখেন। বস্তুর চেয়ে অপ্রয়োজনকে দেখেন। তিনি আজিজুর রহমান তুহিন, সহকারী অধ্যাপক, সঙ্গীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে শিক্ষকতা করেছেন ছায়ানটে, করছেন সুরের ধারায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্র দর্শন প্রসারে নিরলস কর্মী, কিছুটা নিভৃতচারী এই শিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতায়Ñ পপি দেবী থাপা আনন্দকণ্ঠ : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার , শিক্ষা... তুহিন : জন্ম কুষ্টিয়া জেলায়। বাবা ছিলেন সরকারী ডাক্তার। তাঁর পেশার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। আমরা তিন বোন তিন ভাই। ভাই বোনেরা অল্প বেশি সকলেই গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আনন্দকণ্ঠ : সঙ্গীত শিক্ষা শুরু ... তুহিন : কুমিল্লা লাকসামে যখন ছিলাম তখন থেকে গান গাওয়া শুরু করি। বোন গান গাইত বলে গান শেখা। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রীতির কারণ... তুহিন : রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ইচ্ছা জেগেছিল বন্যা দিদির গান শুনে। পারটিকুলারলি বলতে গেলে ‘দ্বীপ নিভে গেছে মম’ এই গানটির কথা বলব। তখন তো ছোট ছিলাম। গানের বাণী, সুর কতটা বুঝেছিলাম জানি না তবে গানটি আমায় খুব টেনেছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বেশি ভালবাসা, এটাকে প্যাশান হিসেবে নেয়াটা হয়েছে; শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার অগ্রসরতা... তুহিন : আমার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল নবম-দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় থেকেই। তখন তো অভিভাবকরা মনেই করতেন না যে গান শেখাটা পড়ালেখার বিষয় হতে পারে। যথারীতি আমার বাবাও বিষয়টি মানতে পারেননি। তখন ইন্ডিয়ান স্কলারশিপ স্কিলে দেয়া বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করলাম। বৃত্তি পেলাম। ১৯৯১ সালে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ১৯৯২ সালে শান্তিনিকেতনে যাই। আনন্দকণ্ঠ : শান্তিনিকেতনের সুখকর স্মৃতি... তুহিন : শান্তিনিকেতনে যেদিন প্রথম যাই, সেদিন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ তারিখ। যখন বোলপুর স্টেশনে এলাম তখন রাত সাড়ে আটটা। আমরা একত্রে চার জন। আমি অদিতি মহসিন, ফেরদৌসি আহমেদ লীনা, মনসুরা বেগম। চারপাশ অন্ধকার। অচেনা, অজানা জায়গা। আমরা রিক্সা নিয়ে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। যখন আশ্রমে প্রবেশ করলাম, ভিন্ন রকমের এক রোমাঞ্চ কাজ করেছিল। এরপর ছয় বছরে অনেক স্মৃতি সঞ্চয় হয়েছে। তবে প্রথমদিনের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি নেই। আনন্দকণ্ঠ : শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত শিক্ষা পদ্ধতি আর দেশীয় পদ্ধতির মধ্যে মিল অমিল... তুহিন : শান্তিনিকেতন হচ্ছে আশ্রম। সকাল সাতটা পৌনে সাতটার মধ্যে ক্লাস শুরু আবার দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে শেষ। তারপর অফুরন্ত সময়। কেউ চাইলে গানের মধ্যে থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে পারে। আবার চাইলে নাও পাড়ে। এত কঠিন জীবন শান্তিনিকেতনে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলব, প্রতিনিয়ত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদেরও পাল্টাচ্ছে। আমরা যেভাবে পড়েছি সে ভাবে তো আমরা পড়াই না। আমাদের ক্যারিকুলাম আর শান্তিনিকেতনের ক্যারিকুলাম এক না। অপর দিকে ছায়ানট, সুরের ধারা, বাফা এগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করা ঠিক হবে না। আমি ছায়ানট অথবা সুরের ধারার শিক্ষক হিসেবে গানকে যে ভাবে দেখব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সেভাবে না। আমার দুই জায়গার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। একটি হচ্ছে একাডেমিক জায়গা অনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটা রেগুলার অন্যটা সাপ্তাহিক। তথ্য শিক্ষার একটা অনুসঙ্গ হতে পারে, তথ্য তো জ্ঞান না। পাঁচ বছর ধরে জানার পর ছেলেমেয়েরা ভুলে গিয়ে যা থাকবে তাই হচ্ছে শিক্ষা, জ্ঞান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা গান শুদ্ধ করে শেখানোর চেষ্টা করি। কিন্তু একাডেমিতে বোঝানো হয় কোন্টা শুদ্ধ আর কোন্টা ভুল। উনি ওভাবে গেয়েছেন উনি এভাবে গাইছেন, তুমি এভাবে গাইছ এখন তোমার কাছে বিষয়টাকে যেভাবে ভাল লাগে তুমি সে ভাবে এগুবে। আনন্দকণ্ঠ : সঙ্গীত শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে একজন সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে আপনার ভাবনা... তুহিন : আমি চাই না আমার ছাত্র কেবলই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হবে। আমি চাই, গান গাইবার সঙ্গে সঙ্গে সে সঙ্গীতকে সব দিক দিয়ে ধারণ করবে। ফাইন আর্ট হিসেবে গানের অবস্থান সম্পর্কে জানবে। শুধুই সঙ্গীত নয় শিল্পকলার সঙ্গে সযুক্ত অন্য বিষয়গুলোও তাকে জানতে হবে। আনন্দকণ্ঠ : আপনার দৈনন্দিন জীবনে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে ধরা দেন। তুহিন : আমি কাজের মধ্যে বা মনুষ্যত্বে রবীন্দ্রনাথকে পাই। মানুষ হিসেবে আমার যে উপলব্ধি সেই খানে রবীন্দ্রনাথকে পাই। কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যের কারনে আমি মানুষÑ বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ আমায় চিনিয়েছেন। তিনি হাতে ধরে বুঝিয়েছেন, তুমি মানুষ, তুমি রূপকার। আমি শিল্পী বলেই আমি মানুষ। আমার চেতনাতে রং আছে কিন্তু আর কোন প্রাণীর চেতনায় নেই। সেটাকে আমি প্রকাশ করলে আমি শিল্পী, না করলে আমি শিল্পী না? নিশ্চই তখনও শিল্পী। সবাই তো সমান ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রসাহিত্যের কোন্ দিকটি আপনাকে বেশি উজ্জীবিত করে? তুহিন : গান তো আমার পছন্দই। তবে বেশি পছন্দ রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্য। যেখানে মানুষের ধর্ম, তার নীতিবোধের কথা, শান্তির জয়গাঁথার উল্লেখ রয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যে মনুষ্যত্বের ব্যাখ্যাগুলো সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রবন্ধ সাহিত্য আমায় যা শিখিয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথের মতো করেই বলি ‘আমি মানুষ বলেই দিগন্ত দেখি। আমি বড়কে দেখি। আমি রং দেখি, বস্তুকে দেখি না। আমি অপ্রয়োজনকে দেখি।’ আনন্দকণ্ঠ : বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রসঙ্গীত কিভাবে, কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে তুহিন : যারা সমাজ পরিচালনা করেন তারা যদি রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে দেখতে পেতেন, তাহলে মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলো চিনতে পারতেন। পার্থক্য করতে পারতেন মনুষ্যত্ব আর পশুত্বের। তার ভাবনায় এ বিষয়টি সব সময় তাড়িত হত মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে পশুত্বকে কিভাবে ওভারকাম করা যায়। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রসঙ্গীতে, সময় এবং পরিস্থিতির ভিত্তিতে একই গানের ভাব অনুভবের ভিন্নতা সম্পর্কে যদি বলেন তুহিন : সুর ও বাণীর উপলব্ধি বয়স ভেদে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিবর্তন হয়। সহজ একটি উদাহরণ দেই যদিও এটি রবীন্দ্রনাথের কম বয়সে রচিত গান, আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো। একজন ১৬ বছরের তরুণ গানটির এই লাইনকে মূল কথা ভাববে। কিন্তু আমি ভাবব আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন তোমাতে করিব বাস। এই লাইন। আনন্দকণ্ঠ : রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথা ও সুরের রূপ বর্ণনা তুহিন : আমরা কি সব সময় সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি? কিন্তু গান আমরা উপভোগ করি। আমরা যখন গান শুনি তখন কথা ও সুরের মিশ্রণে তৃতীয় একটা কিছু শুনি। সেখানে কথা যেমন সুরকে ছাপিয়ে যায় না, সুরও তেমনি কথাকে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন ‘বাক্যের দাসত্ব করা গানের কাজ না।’ এ বিষয় রবীন্দ্রনাথের একটি গান থেকেই বলি ‘বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে কাজ নাই, ভাল আমার লেগেছে যে রইল সেই কথাই। আনন্দকণ্ঠ : সঙ্গীত নিয়ে কোন স্বপ্ন ... তুহিন : স্বপ্ন না ইচ্ছা আছে। রবীন্দ্রনাথের গানের গল্পগুলো থেকে উপাদান নিয়ে তা নতুন করে তুলে ধরার।
×