ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি

যাত্রার শুরুতেই ছিল অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২ আগস্ট ২০১৮

যাত্রার শুরুতেই ছিল অনিয়ম

শ.আ.ম হায়দার, পার্বতীপুর ॥ বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মে.ও তাপবিদ্যুত কেন্দ্র কয়লার অভাবে যখন বন্ধ হয় তখন চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। শুরু হয় কয়লাখনি নিয়ে টানাহেচড়া। তবে পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু থাকলে খনি কর্তৃপক্ষকে আজকের এ অরাজক অবস্থায় পড়তে হতো না। এ প্রতিষ্ঠানের যে গোড়ায় গলদ, যার যাত্রা শুরু অনিয়মের মধ্য দিয়ে এ নিয়ে কেউ ভাবছে না, কথা বলছে না। যত কথা হচ্ছে কয়লা চুরি নিয়ে। শুধু কয়লা চুরি কেন? খনিকে টার্গেট করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরিকল্পিতভাবে ঠা-া মাথায় সাগর চুরি করেছে, এ হিসেব নেয়ার এখন সময় এসেছে। এ মতামত একাধিক খনি বিশেষজ্ঞদের । সূত্র মতে, বড়পুকুরিয়া কোল বেসিনটি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়। ওডিএর আর্থিক সহায়তায় পেট্রোবাংলা ১৯৮৭ হতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ড্রেল আর্মস্ট্রং নামক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়লা মজুদের ওপর একটি বিস্তারিত আর্থ-কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই সমীক্ষার ভিত্তিতে বছরে ১.০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ভূ-গর্ভস্থ খনি স্থাপনের লক্ষ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ প্রকল্পের পিপি ১৯৯৩ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে অনুমোদিত হয়। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে খনির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। সরবরাহ ঋনের আওতায় পেট্রোবাংলা এবং চাইনিজ কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে ১৯৯৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি একটি নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে খনি উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ গতিশীল করার এবং শেষে সুষ্ঠুভাবে খনি পরিচালনা করার উদ্দেশে ১৯৯৮ সালের ৪ আগস্ট তারিখে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড গঠন করা হয়। এই খনির উৎপাদিত কয়লার ওপর ভিত্তি করে ২০০৩ সালে পিডিবি বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করে। ২০০৫ সালের ৩০ জুন ১,৪২৯.৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়লা খনি প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়। খনি হতে নিরবচ্ছিন্ন কয়লা উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০০৫ সালের ৪ জুন সিএমসি ও সুঝো কোল মাইনিং গ্রুপ কোম্পানির (এক্সএমসি) কাজের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হতে কয়লা উৎপাদন শুরু হয়। কয়লা খনির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলে অনিয়ম, দুর্নীতি , দায়িত্বহীনতা ও লুটপাট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। রাষ্ট্রের টাকায় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। অথচ শেয়ার না দিয়েই পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানসহ পদস্থ কর্মকর্তারাই কাগজে কলমে বিসিএমসিএল’র শেয়ারহোল্ডার । শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখলেও পেট্রোবাংলাই সর্বেসর্বা। মন্ত্রণালয়কে আড়াল করে তারা খনির ওপর খবরদারি করে আসছে। তাদের যারা (পেট্রোবাংলার) পছন্দের, তারাই খনিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পায়। পেট্রোবাংলার নির্দেশনার বাইরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোন কিছু করার সুযোগ নেই। বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে তারা উৎপাদিত কয়লার লভ্যাংশ, প্রফিট বোনাসসহ যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে। তবে এতদিনেও তারা খনির কয়লার সিস্টেম লসের বিধান রাখেনি। কেন রাখেনি? সঙ্গত কারণে কথা উঠেছে, সিস্টেম লস দেখালে তাদের প্রফিট বোনাস ও লভ্যাংশ কমে যাবে এ কারণে তারা এ থেকে বিরত ছিল। জানা গেছে, আমিনুজ্জামান বড়পুকুরিয়ায় এমডি থাকাকালীন খনির কয়েক কর্মকর্তা কমিটির মাধ্যমে সিস্টেম লসের খসড়া প্রপ্রোজাল তৈরি করেছিলেন। তবে এমডির দ্বিমতের কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। তার উদ্দেশ্য যে ভাল ছিল না এ দিয়ে তাকি বোঝা যায় না? বাহির থেকে সুবিধাভোগীদের ডেকে এনে ডিওর নামে খনি থেকে কয়লা উজাড় করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উত্তোলিত কয়লায় দেশের সমৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এ উদ্দেশেই রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকায় এই খনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে কি এ দায়িত্ববোধ, ভাবনা ও দেশপ্রেম ছিল? সরকারী বেতনভুক্ত আমলারা বেতন-ভাতার সঙ্গে লভ্যাংশ ও প্রফিট বোনাসের লাখ লাখ টাকা উত্তোলন ছাড়াও কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের সুবিধা ভোগ করেছে ঠিকই তবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি। বরং নিজেদের প্রয়োজনে জোড়াতালি ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে খনি চালানো হয়েছে বলে কথা উঠেছে। এতদিন সবাই চুপচাপ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। পার্বতীপুর মডেল থানায় ১৯ অভিযুক্তের নামে ২৪ জুলাই/১৮ তারিখে দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং ৪০৯ ধারায় মামলা হয়েছে। দুদকের হাতে তদন্ত ন্যস্ত হয়েছে। দাবি উঠেছে স্বচ্ছ তদন্তে ঘটনার মূল হোতাদের অবৈধ সম্পদের হিসাবসহ অপরাধ চিহ্নিত করে অপরাধীদের আইনে সোপর্দ করা হোক । দেশবাসী অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চায়, কোনক্রমে যেন আই ওয়াস না হয়। যদি হয় তবে তা থাকবে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে।
×