ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বোচ্চ শাস্তি কাম্য

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২ আগস্ট ২০১৮

সর্বোচ্চ শাস্তি কাম্য

বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কে দুই কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু দেশজুড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। দুঃখজনক হলেও, মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা নিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রীর (যিনি একজন পরিবহন শ্রমিক নেতাও বটে) কিছু অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত না করে ঘৃতাহুতি দেয়। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাকে সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বোধকরি বিশ্বে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১২ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে সাড়ে ৫১ হাজার। এতে নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৬ জন, আহত হয়েছেন ৯৩ হাজার ৫০৬ জন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, ওভারলোডিং-ওভারটেকিং, চালকদের বিরামহীন গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অনুসরণ না করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অযান্ত্রিক-অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল, সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ ও বাঁকবহুল সড়ক যোগাযোগ। অবশ্য আশার কথাও শুনিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বছরভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে আসছে। মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ক্রমশ। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো নিয়ন্ত্রণ, মাদকাসক্ত চালক নিয়োগ বন্ধ ও লাইসেন্স বাতিল, মোবাইলকোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি, জনসচেতনতামূলক প্রচার ইত্যাদি। এর পাশাপাশি হাইওয়ে প্যাট্রোল পুলিশের নিয়মিত নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশও রয়েছে। জেল-জরিমানার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রথম সড়ক পরিবহন আইনে যানবাহন চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে ন্যূনতম ৮ম শ্রেণী এবং সহকারীর যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী পাস। পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে বয়সও বেঁধে দেয়া হয়েছে, ২১ বছর। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রণীত এই আইনে তিন রকম শাস্তি দেয়া যাবে দ-বিধির অধীনে। নরহত্যা (উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে) হলে ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হবে। যাতে শাস্তি মৃত্যুদ-। আর খুন নয়, এমন ঘটনায় ৩০৪ ধারা অনুযায়ী সাজা দেয়া যাবে যাবজ্জীবন। আর শুধু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য হলো ৩০৪ (খ) এর জন্য তিন বছরের কারাদ-। এর ফলে শেষ পর্যন্ত যানবাহন মালিক ও চালকদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’- সংগঠনের তথ্যমতে, দেশে প্রতি হাজার যানবাহনে নিহতের সংখ্যা বছরে ১৬৯ জন। অথচ অত্যধিক যানবাহনের দেশ জাপানে এই মৃত্যুর হার মাত্র দুজন। শুধু ট্রাফিক আইনকানুন কঠোরভাবে মানার কারণেই জাপানে দুর্ঘটনার হার অবিশ্বাস্যভাবে কম। এর বিপরীতে বাংলাদেশে বিরাজ করছে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা। এখানে সারাদেশে তো বলাইবাহুল্য, এমনকি রাজধানীতেও প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চলে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার প্রতিযোগিতা। সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৭ম। কোন কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। সে অবস্থায় এ রকম একটি দুর্বল আইন হলে চালকরা যে আরও বেপরোয়া হবে এবং বাড়বে সড়ক দুর্ঘটনা তাতে কোন সন্দেহ নেই। সত্য বটে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কেবল ড্রাইভার দায়ী নয়। বরং ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ভুল সিগন্যাল, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন, অসতর্ক যাত্রী ও পথচারী, সড়কের পাশে হাটবাজার, সড়কের যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। প্রশিক্ষিত-স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন চালকেরও অভাব প্রকট। বিআরটিএসহ ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থা, ঘুষ-দুর্নীতিও এর জন্য দায়ী অনেকাংশে। সভ্য ও উন্নত হতে হলে এসব বাধাই আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে পর্যায়ক্রমে। তবু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেহেতু চালককে প্রাথমিকভাবে দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, সেহেতু শাস্তির বিধান একটু বেশি রাখা হলে সে সতর্ক ও সাবধান হতে পারে। আর সতর্ক ও সাবধান হলে সড়ক দুর্ঘটনার হার এমনিতেই কমে আসবে।
×