ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া জড়িত থাকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী

‘দুঃখ একটাই- জিয়ার বিচারটা করতে পারলাম না’

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২ আগস্ট ২০১৮

‘দুঃখ একটাই- জিয়ার বিচারটা করতে পারলাম না’

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন বলেই তিনি আত্মস্বীকৃত খুনীদের পুরস্কৃত করেছেন। তবে জিয়াউর রহমানের যে পরিণতি হয়েছিল তা অবধারিত। কিন্তু আমার দুঃখ একটাই, তার (জিয়াউর রহমান) বিচারটা আমি করতে পারলাম না। তার আগেই সে মারা গেল। বুধবার বিকেলে ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবন স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্নে শোকাবহ ১৫ আগস্টের মাসব্যাপী কর্মসূচীর সূচনা দিনে বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত রক্তদান কর্মসূচী ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার এই গতি যেন থেমে না যায়। দেশের অগ্রগতির এই ধারা ধরে রেখেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সুখীসমৃদ্ধ তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শোকের মাসের সূচনা দিনে রক্তদান কর্মসূচীর আয়োজন করে কৃষক লীগ। সংগঠনটির সভাপতি আলহাজ মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামসুল হক রেজা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কৃষিবিদ সমীর চন্দ্র। আলোচনা সভা শেষে কৃষক লীগের নেতাকর্মীরা নিজের দেহ থেকে এক ব্যাগ করে রক্ত দিয়ে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আর এ কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কী অপরাধ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর? অপরাধ তার একটাই ছিল যে, তিনি বাঙালী জাতির মুক্তি এনে দিয়েছিলেন, দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, বাঙালী জাতিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসর কুলাঙ্গাররা পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। তাই একাত্তরের গণহত্যাকারী রাজাকার-আলবদর-আলশামসরা, ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধে গেলেও যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করত না- তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। তারা মনে করেছিল, জাতির পিতাকে হত্যা করলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে না, এ দেশ পাকিস্তানের হাতে আবার চলে যাবেÑ এই উদ্দেশ্য নিয়েই বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান খুনীদের বিচার না করে উল্টো বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এসব কাজ কেন করেছেন? কারণ জিয়াউর রহমান এই হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত ছিলেন বলেই খুনীদের পুরস্কৃত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- পরবর্তী পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে থাকায় শেখ রেহানাসহ আমি প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান আমাদের দীর্ঘদিন দেশে আসতে দেননি। আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত করার পর জোর করে দেশে ফিরলেও ওই জিয়া আমাকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়নি। আমরা দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বাড়ির বাইরের রাস্তায় বসে বাবা-মা, ভাইসহ নিহত স্বজনদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেছি। ওই সময় আমাকে অন্য একটি বাড়ি দিতে চেয়েছিল। আমি স্পষ্ট করে বলেছি, খুনীদের কাছ থেকে আমি কিছু নেব না। এ প্রসঙ্গে আবেগজড়িত প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর নামটুকুও মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। একটি প্রজন্মকে বিকৃত ইতিহাস শেখানো হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ পর্যন্ত বাজাতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের নাম এলেই তো আসবে বঙ্গবন্ধুর নাম। সেই নামটি পর্যন্ত তারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সত্য ইতিহাসকে কখনো মুছে ফেলা যায় না। বরং ইতিহাসই একদিন প্রতিশোধ নেয়। তাই জিয়ার যা পরিণত হয়েছিল তা অবধারিত। কিন্তু আমার একটাই দুঃখ, আমি তার বিচার করতে পারলাম না। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের অনেকেরই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। খুনী ডালিম ও তার স্ত্রী আমাদের বাড়িতে প্রায় সময়ই পড়ে থাকত। খুনী নুর ও আমার ভাই শেখ জামাল দু’জনই কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। অথচ খুনী মোশতাকসহ এসব মীরজাফরাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল। তিনি বলেন, খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করেছে তা বিবিসির সাক্ষাতকালে দুই খুনী ফারুক-রশীদ বলে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় স্বীকার করে ওই দুই খুনী সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছে, অনেক চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা কমানো যায়নি। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা ছিল পাহাড়সম। তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছাড়া অন্য কোন পথ তাদের কাছে ছিল না। ওই দুই খুনী সাক্ষাতকারে এও বলেছে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের কথা জিয়াউর রহমান জানতেন। খুনীদের জিয়া বলেছে, তোমরা এগিয়ে যাও, আমি তোমাদের সফলতা কামনা করছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর খুনী-বেঈমান মোশতাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েম সাহেবকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে নিজে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এর পর দেশে প্রায় ১৯টা ক্যু হয়েছে। এ সময় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার-সৈনিককে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করে। নির্বাচনে কারচুপি, দুর্নীতি, ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি এই জিয়াই সৃষ্টি করে গেছে। এ সময় দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশের জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল বলেই আমরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছি। অনেক বাধা, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে যে ক’জন খুনীকে আমরা ধরতে পেরেছি তাদের ফাঁসির রায় আমরা কার্যকর করেছি। আর যেসব খুনী এখনও পলাতক রয়েছে তাদের খুঁজে বের করে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিদেশে পলাতক দুই খুনীকে ধরে এনে রায় কার্যকর আমরা করেছি। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগযাত্রার গতি যেন কোনভাবেই থেমে না যায় সেজন্য দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধামুক্ত করেছি, এখন দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মহাকাশ, সমুদ্র জয় করেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রত্যেকটা দেশের অর্জনের সময় আমার মনে হয় নিশ্চয়ই আমার বাবা-মা বেহেস্ত থেকে এসব দেখতে পাচ্ছেন, দেশের মানুষ ভাল আছে এটা দেখে তারা শান্তি পাচ্ছেন, লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি আমার ওপর বারবার আঘাত এসেছে। আরও হয়ত আসবে। আমি সেগুলো পরোয়া করি না। মৃত্যুকে কখনও পরোয়া করিনি। আমি শুধু এইটুকুই মনে করি, আমি তো বেঁচেই আছি, আমার বাবার অধরা কাজগুলো সম্পন্ন করতে। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। বাংলাদেশকে বিশে^ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে। অন্তত বলতে পারি, আজকে বাংলাদেশ সারাবিশে^ একটা মর্যাদার আসন পেয়েছে, আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ নিশ্চয়ই আমার আব্বার আত্মা শান্তি পায়। দেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু বুকের রক্ত দিয়ে তার কথা রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত ঋণ আমাদের অবশ্যই শোধ করতে হবে। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করে যেতে চাই। ইনশাল্লাহ আমরা তা পারব, এই বিশ্বাস আমাদের আছে। কারণ আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আরও এই দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। দেশবাসীর অব্যাহত সহযোগিতা ও সমর্থন কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সব দিক থেকে আজ এগিয়ে যাচ্ছে, আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার গতি যেন থেমে না যায়। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির গতি যেন অব্যাহত থাকে- এজন্য সবার সহযোগিতা চাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্নের পথ বেয়েই আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবই ইনশা আল্লাহ।
×