ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়ে পরে সফল যেসব ফুটবলার...;###;রুমেল খান

মেসি কি পারবেন তালিকায় পঞ্চদশ হতে?

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১ আগস্ট ২০১৮

মেসি কি পারবেন তালিকায় পঞ্চদশ হতে?

হয় এবারই, নয়তো কখনই নয়। বিশ্বকাপ ফুটবল আসর শুরুর আগে গোটা আর্জেন্টিনায় এমনই এক রব উঠে গিয়েছিল। গতবার ফাইনালে উঠে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল, এবার হয়েছে আরও অনেক আগেই, দ্বিতীয় রাউন্ডে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার কাতারে যাবার প্রচেষ্টা আরেকবার পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়। নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, কার কথা বলছি। হ্যাঁ, লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অবশ্য মেসি বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা দলের যে অবস্থা তাতে দলটা যদি সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠতে পারে, তাহলেই ধরে নেব অনেকদূর এসেছে।’ না, মেসির ধারণা সত্যি হয়নি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বয়স্ক দল, সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ফর্মেশন এবং সবচেয়ে ভঙ্গুর রক্ষণভাগ নিয়ে আর যাই হোক কোন দল চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না। আর্জেন্টিনা দলের বেলাতেও তাই হয়েছে। বিশ্বকাপ চলাকালেই মেসির বয়স ৩১ পূর্ণ হয়েছে। পরের ২০২২ বিশ্বকাপে যদি মেসি খেলেন তাহলে তখন তার বয়স হবে ৩৫। প্রশ্ন উঠেছে, সে সময় পর্যন্ত কী মেসির ফর্ম-ফিটনেস থাকবে? মেসি অবশ্য খেলার ব্যাপারে আশাবাদী। কেননা ইতোমধ্যেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেনÑ ‘বিশ্বকাপ জিতি আর না জিতি, আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা চালিয়ে যাব।’ নকআউট স্টেজে ফ্রান্সের কাছে হারার পরই অবসরে ঘোষণা দিয়েছেন আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার জাভিয়ের মাশ্চেরানো। তার প্রত্যাশা, মেসি যেন জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যান। তবে এখানে প্রশ্ন আসবেÑ ২০২২ বিশ্বকাপে মেসি কতটা কার্যকর ফুটবলার হিসেবে খেলতে পারবেন। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন ফর্ম-ফিটনেস ঠিক থাকলে বয়স কোন সমস্যা নেই। কেননা অনেক গ্রেট ফুটবলারও বেশি বয়সে বিশ্বকাপ খেলেছেন। তাছাড়া মেসির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো তো ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছেনÑ তিনি খেলতে চান ৪১ বছর পর্যন্ত (এখন তার বয়স ৩৩, মেসির চেয়ে দু’বছরের বড়)। কাজেই রোনাল্ডো পারলে মেসিও পারবেনÑ এমনটাই বিশ্বাস করার লোক বেশি। আরেকটা ব্যাপারÑ মেসি যদি ২০২২ বিশ্বকাপে খেলেন তাহলে তিনি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই জানবাজি লাগিয়ে দেবেন। যদি সফল হন, তাহলে তিনি এমন এক তালিকায় প্রবেশ করবেন যে তালিকাটি অনেক আলাদা। ইতিহাস সাক্ষীÑ মেসিই প্রথম নন যিনি একবার ফাইনাল খেলে পরে আর বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, মোট ১৪ ফুটবলার আছেন যারা বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে প্রথমে ব্যর্থ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু পরে বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ যেন বাংলা কবিতার সেই লাইনের মতো, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার’-এর মতো। পরাজয় মানেই ব্যর্থতা নয়। আর ব্যর্থতাই হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি। মেসি এখন অনুপ্রেরণা নিতে পারেন সেই ১৪ জনের কাছ থেকে, যারা প্রথমে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকই নাম লিখিয়েছিলেন সফলদের তালিকায়। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। নতুন ধরনের ডিফেন্সিভে ‘সুইপার’ পজিশনের খেলোয়াড়। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলেন ১৯৬৬ আসরে। সেবার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ৪-২ গোলে হেরে যায় স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে এ দুঃখ ভুলেছিলেন। সেবার স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি ২-১ গোলে হারায় হল্যান্ডকে। যদিও ম্যাচে আগে গোল করেছিল হল্যান্ডই। বেকেনবাওয়ার সেবার ছিলেন দলনায়ক। কিংবদন্তি জার্মান গোলরক্ষক সেপ মেয়ার। জিতেছেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপ। তবে এর আগে হেরেছিলেন ১৯৬৬ বিশ্বকপের ফাইনাল। সেবার অবশ্য ফাইনালে খেলতে পারেননি। ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। তার স্থলে খেলেছিলেন নিয়মিত গোলরক্ষক হ্যান্স টিল্কোউইস্কি। হর্স্ট-ডাইটার হোয়েটেজ। জার্মান ডিফেন্ডার (ফুল ব্যাক)। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৬৬ ম্যাচ। গোল করেন ১টি। ১৯৬৬ আসরের ফাইনালে খেলে হেরে যান। তবে ১৯৭৪ আসরের ফাইনালে না খেলেও লাভ করেন শিরোপাজয়ের স্বাদ। সেদিন ডাচদের বিরুদ্ধে ম্যাচে কোচ হেলমুট শোয়েন তিক্ত সম্পর্কের কারণে মাঠেই নামাননি হোয়েটেজকে। এর ফলে বিশ্বকাপ জিতেই অভিমানে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটান হোয়েটেজ। জুর্গেন গ্রাবোস্কি। জার্মান ফরোয়ার্ড। তবে ৪৪ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন মাত্র ৫টি। ১৯৬৬’র ফাইনালে হারের স্বাদ পেয়েছিলেন। যদিও সে ম্যাচে তিনি ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। ১৯৭৪-এর ফাইনালে কোচ তাকে ঠিকই খেলান। ডাচদের বিরুদ্ধে নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। ফলাফলÑ বিশ্বকাপ জয়ের অনাবিল চিত্তসুখ। জার্মান মিডফিল্ডার উল্ফগ্যাংগ ওভার‌্যাথ। ১৯৬৬, ১৯৭৪Ñ দুই ফাইনালেই খেলেছেন। জিতেছেন শেষের ফাইনাল। ১১ বছরের ক্যারিয়ারে ৮১ ম্যাচ খেলে করেন ১৭ গোল। ’৭৪ বিশ্বকাপ জয় শেষেই অবসর নেন তিনি। পিয়েরে লিটবারস্কি। জার্মান উইঙ্গার-এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। ১৯৮১-৯০ সালের ক্যারিয়ারে ৭৩ ম্যাচ খেলে করেন ১৮ গোল। ১৯৮২ আসরে ইতালির বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলেন, দল হারে। ১৯৮৬ আসরে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে দল হারে, তবে তিনি সে ম্যাচে খেলেননি। ১৯৯০ আসরে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে খেলেন। এবার তার দল জয়ী হয়। একই অবস্থা লিটবারস্কির আরও দুই সতীর্থ লোথার ম্যাথাউস এবং রুডি ভোলারের। সুইপার ও মিডফিল্ডার পজিশনে খেলা এবং বিশ্বকাপে সর্বাধিক ২৫ ম্যাচ খেলা ম্যাথাউস ১৯৮২ আসরে জার্মানি স্কোয়াডে থাকলেও সেবারের ফাইনালে তাকে খেলানো হয়নি। পরের আসরে ১৯৮৬তে ছিলেন অধিনায়ক। কিন্তু ফাইনালে হেরে যান আর্জেন্টিনার কাছে। ১৯৯০ আসরে এবার সেই আর্জেন্টিনাকেই হারিয়ে বদলা নেন এবং কাপ জয়ের স্বাদ লাভ করেন ১৫০ ম্যাচে ২৩ গোল করা ম্যাথাউস। জার্মানির হয়ে ৯০ ম্যাচে ৪৭ গোল করেছেন ফরোয়ার্ড রুডি ভোলার। এর একটি গোল ছিল আবার ১৯৮৬ আসরের ফাইনালে। কিন্তু সেবার তার দলকে হারতে হয়েছিল। খেলেছিলেন বদলি হিসেবে। ১৯৯০ আসরের ফাইনালেও তাই। কিন্তু সেবার আর গোল না পেলেও বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পেয়েছিলেন ঠিকই। মিরোসøাভ ক্লোসা। ২০১৪ আসরে দুই গোল করে পরিণত হন বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতায়। তার সঙ্গে যোগ হয় বিশ্বকাপ জেতার দ্বিগুণ আনন্দ। কিন্তু বিশ্বকাপ তিনি জিততে পারতেন সেই ২০০২ সালেই। সেবার ব্রাজিলের কাছে ফাইনালে ০-২ গোলে হেরেছিল জার্মানি। ফরোয়ার্ড ক্লোসা খেলেছিলেন ম্যাচের ৭৪ মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু গোল করতে পারেননি। ২০১৪ আসরের ফাইনালেও গোল পাননি। কিন্তু পান তারচেয়েও বড় পুরস্কারÑ বিশ্বকাপ! দিনো জফ। কিংবদন্তি ইতালিয়ান গোলরক্ষক। খেলেছেন ১১২ ম্যাচ। ১৯৭০ আসরের ফাইনালে দলের নিয়মিত গোলরক্ষক এনরিকো আলবার্তোসির কারণে ছিলেন সাইডবেঞ্চে। ইতালি হারে ৪-১ গোলে। ১৯৮২ আসরের ফাইনালে আবারও খেলে ইতালি। এবার প্রতিপক্ষ জার্মানি। জফ এবার অধিনায়কের ভূমিকায়। ফাইনালে ৩-১ গোলে জিতে ইতালি। কাপ ওঠে জফের হাতে। এছাড়া ১৯৫০ আসরের চূড়ান্ত ম্যাচে (সেবার ফাইনাল হয়নি, আসর হয় লীগ পদ্ধতিতে) হেরেও (সে ম্যাচে অবশ্য খেলেননি) ১৯৫৮ আসরের ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে জেতেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক কার্লোস জোসে কাস্তিলহো, ১৯৯৮ আসরের ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরেও ২০০২ আসরের ফাইনালে জিতে কাপ জয়ের স্বাদপূরণ হয় ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস, রিভাল্ডো, ডেনিলসন ও ডিডার। শেষের জন অবশ্য কোন ফাইনালেই খেলেননি। মেসি কী পঞ্চদশ খেলোয়াড় হিসেবে এই তালিকায় নিজের নাম ওঠাতে পারবেন ২০২২ বিশ্বকাপে?
×