ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাশরাফির নেতৃত্বে উজ্জীবিত বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১ আগস্ট ২০১৮

মাশরাফির নেতৃত্বে উজ্জীবিত বাংলাদেশ

২০০৬ সালে কেনিয়া সফরে ওয়ানডে সিরিজ জয় (৩-০) কিংবা জিম্বাবুইয়ে সফরে ৩-১ ব্যবধানে জয়গুলো কেউ মনে রাখেননি। কারণ, কেনিয়া ছিল আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশ আর জিম্বাবুইয়ে টেস্ট খেলুড়ে দল হলেও সে সময় ধুঁকছিল দেশের ক্রিকেটে অস্থিরতার জন্য। তবে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়টি মনে রাখার মতোই। সেটিই স্বীকৃত কোন শক্তিধর দলের বিপক্ষে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জয় বাংলাদেশ দলের। একই বছর পুনর্গঠিত জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে আর কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জয় নেই। গত ৯ বছরেও আর আসেনি। অথচ দেশের মাটিতে একের পর এক সাফল্য ধরা দিচ্ছিল টাইগারদের। কিন্তু এবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৯ বছর পর বিদেশের মাটিতে আবার ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে আক্ষেপ ঘুচিয়েছে টাইগাররা। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে এই সাফল্য পেয়েছে সফরকারীরা। তিনি দাবি করেছেন পেশাদার পারফর্মেন্সেই এই সাফল্য ধরা দিয়েছে। কিন্তু উন্নতি করার মতো অনেক ফাঁকফোকরও খুঁজে পেয়েছেন ওয়ানডে অধিনায়ক এ নড়াইল এক্সপ্রেস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের শুরুতেই এবার দেশের কোটি ক্রিকেট ভক্তকে দারুণভাবে হতাশ করে বাংলাদেশ। ভয়াবহ রকমের বাজে নৈপুণ্য দেখিয়ে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়। কিন্তু মাশরাফি যেন জাদুর কাঠি। হতাশ, ভগ্ন আত্মবিশ্বাস আর মুষড়ে পড়া দলকে যেন মুমূর্ষু অবস্থা থেকে পুরোপুরি সতেজ আর উজ্জীবিত করে তোলেন। প্রথম ওয়ানডেতেই জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ দল। সিরিজের প্রথম দুটি ওয়ানডে গায়ানাতে হয়েছে। প্রথম ওয়ানডেতে ৪৮ রানে জিতে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আক্ষেপের হার হয়েছে। জয়ের কাছে গিয়েও ৩ রানে হারতে হয়েছে। শেষ ওভারে হেরেছে বাংলাদেশ। তাতে করে সিরিজে ১-১ সমতা আসে। সেন্ট কিটসে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যে দল জিতত, সিরিজ তাদেরই হয়ে যেত। সিরিজ বাংলাদেশেরই হলো। ১৮ রানে জিতে সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তাতে করে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার হতাশা দূর হয়েছে। সঙ্গে ২০০৯ সালে জিম্বাবুইয়ের মাটিতে জিম্বাবুইয়েকে সিরিজে হারানোর পর যে আর বিদেশের মাটিতে সিরিজ জিততে পারছিল না বাংলাদেশ, সেই গোলকধাঁধা থেকে বের হয়েছে এবার। তা সম্ভব হয়েছে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের অসাধারণ নৈপুণ্যে। তামিম ইকবাল তো সিরিজ জুড়েই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তিন ম্যাচে ১৪৩.৫০ গড়ে দুই সেঞ্চুরি (১৩০* ও ১০৩) ও এক হাফসেঞ্চুরিতে (৫৪) ২৮৭ রান করেছেন তামিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তিন ম্যাচের এক ওয়ানডে সিরিজে যা সর্বোচ্চ রান। প্রথম ও তৃতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচসেরা হয়েছেন তামিম। সিরিজ সেরাও হয়েছে। সিরিজে সর্বোচ্চ রানও তামিমেরই। এমন নৈপুণ্যে তামিম র‌্যাঙ্কিংয়ের ১৩ নম্বরেও চলে আসেন। ১৫ নম্বর থেকে দুই ধাপ এগিয়ে ক্যারিয়ারসেরা র‌্যাঙ্কিং অর্জন করেন তামিম। সাকিব আল হাসানও তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে দেখিয়েছেন ঝলক। ৬৩.৩৩ গড়ে দুই হাফসেঞ্চুরিসহ ১৯০ রান করেছে সাকিব। বল হাতে ২ উইকেট। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ১১০.০০ গড়ে এক হাফসেঞ্চুরিসহ ১১০ রান করেছেন। তৃতীয় ওয়ানডেতে যে অপরাজিত ৬৭ রানের ইনিংস খেলেছেন সেটি বিশেষ কাজে লেগেছে। মুশফিকুর রহীমও ৩৬.৬৬ গড়ে এক হাফসেঞ্চুরিসহ ১১০ রান করেছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজাও শেষ ম্যাচে দেখিয়েছেন ঝলক। প্রয়োজনের সময় ছয় নম্বর ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করতে নেমে যান। ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করে ৩৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংসও খেলেন। দেশের ইতিহাসে সাফল্যে সেরা এই অধিনায়ক বল হাতেও ৭ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা বোলিং করেছেন। সিনিয়ররা নিজেদের মেলে ধরেছেন। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ সিরিজেও জিতেছে। অথচ সিরিজ জিতবে কিনা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ওয়ানডের পর এমন প্রশ্নই উঠেছিল। ওঠার পেছনে যুক্তিও ছিল। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে যেভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ তাতে ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব পড়তেই পারত। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা এখন অনেক পেশাদার। তাদের ভেতর শেষ পর্যন্ত লড়াই করার বিশ্বাস আছে। সেই পেশাদারিত্ব আর বিশ্বাসেই জয় মিলেছে। মাশরাফি যেমন বলেছেন, ‘ক্রিকেট মেন্টাল গেম। আমরা দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচ হেরেছিলাম। যদিও ৪৯ ওভার পর্যন্ত ম্যাচ আমাদের হাতে ছিল। কিন্তু এ ম্যাচে (তৃতীয় ওয়ানডেতে) আমি বলব ছেলেরা পেশাদার পারফর্মেন্স দেখাতে পেরেছে। ছেলেরা দারুণ ছন্দে আছে। তামিম, সাকিব, মুশি (মুশফিক), মাহমুদুল্লাহ দারুণ খেলেছে। বোলাররা তিন ম্যাচেই দারুণ বল করেছে। এখন জুনিয়রদের একটু এগিয়ে আসতে হবে।’ বিশ্বাস ছিল বলেই জয় সম্ভব হয়েছে। অন্যতম পারফর্মার তামিম তেমন দাবিই করেছেন। তবে এ সিরিজে সবচেয়ে বেশি যেটি কাজে লেগেছে, সেটি হচ্ছে তিন নম্বর পজিশনে সাকিবের খেলা। তিন নম্বর পজিশন নিয়ে যে মাথাব্যথা ছিল, সেটি দূর করা। তামিম-সাকিব মিলে প্রতি ম্যাচেই দারুণ খেলেছেন। এমনকি তাদের জুটি বিশ্বরেকর্ডও গড়ে ফেলেছে। তামিম ও সাকিবের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ওয়ানডে সিরিজটি অসাধারণ কেটেছে। তিন ম্যাচ মিলিয়ে দ্বিতীয় উইকেটের জুটিতে মোট ৩৮৫ রান যোগ করে দু’জনে গড়েছেন রেকর্ড। সিরিজের প্রথম ম্যাচে টাইগারদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে রেকর্ড ২০৭ রানের জুটি গড়েন সাকিব-তামিম। দ্বিতীয় ম্যাচে রানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তারা। আসে ৯৭ রানের জুটি। আর সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে তারা তোলেন ৮১ রান। এই তিন ম্যাচ সিরিজে সাকিব-তামিম জুটি মোট ৩৮৫ রান করেছেন। তিন ম্যাচ সিরিজে কোন নির্দিষ্ট জুটির এটিই সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। এর আগে ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা ও কুইন্টন ডি কক বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের ঘরের মাঠে জুটিতে ৩৭২ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন। তামিম-সাকিব প্রতিটি ম্যাচেই ভাল জুটি গড়ে দেয়ায় দলের বাকিরাও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তাতে খেলাও হয় দারুণ। জয়ও মিলে। সিরিজ জয় হওয়াতে নয় বছর পর বিদেশের মাটিতে সিরিজ জেতার আক্ষেপও ঘোচে। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৯ সালে খেলতে গিয়ে প্রথম টেস্টেই ইনজুরিতে পড়ে এখন পর্যন্ত টেস্ট খেলতে পারছেন না মাশরাফি। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে এবার সিরিজ জিতেছেন তিনি। শুধু নয় বছর পর বিদেশের মাটিতে সিরিজ জেতাই নয়, ২২ মাস পর দেশের মাটিতেও ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জেতার পর প্রায় দুই বছর হতে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সিরিজ জিততে পারছিল না। এবার জিতল। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওয়ানডে সিরিজে হারানোর পর আগস্টে জিম্বাবুইয়েকেও সিরিজে হারিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে আর কোন সিরিজে জিততে পারেনি। এরপর দেশের বাইরে ১৪টি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। একটিতেও সিরিজ জয় নেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুইবার ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একবার সিরিজ ড্র করার স্বাদ নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সিরিজ জেতা আর হয়ে ওঠেনি। এবার সেই আক্ষেপ ঘুচল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এর আগে সাতবার দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। হোয়াইটওয়াশ করে। কিন্তু সেই দলটি খানিক দুর্বল ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে দেশের মাটিতে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকেই আবার সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। ২০১১ সালেও দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সিরিজে হারানোর সুযোগ ধরা দিয়েছিল। কিন্তু তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দুই ওয়ানডে হেরে যায় বাংলাদেশ। সিরিজ হার হয়। এবার ৯ বছর পর আবারও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতে হারানোর সুযোগ ধরা দেয়। এবারও সিরিজটি জুলাইতেই হয়। সেন্ট কিটসেই তৃতীয় ওয়ানডে হয়েছিল সেবার। এবারও একই ভেন্যুতে হয় তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। ৯ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে এবং ২০১২ সালে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজে হারানোর হিসেব ধরলে প্রায় ৬ বছর পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর সুযোগ মিলেছে। সেই সুযোগ কাজেও লাগিয়েছে বাংলাদেশ। নয় বছর পর বিদেশের মাটিতে সিরিজ না জিততে পারার হতাশা দূর করেছে।
×