ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটবাসীর জীবনযাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১ আগস্ট ২০১৮

বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটবাসীর জীবনযাত্রা

এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড় ॥ জেলার ৩ উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সেখানে বসবাসকারী মানুষজনের জীবনযাত্রাও বদলে গেছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর মাত্র তিন বছরে আকাশচুম্বী উন্নয়নে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিটমহলবাসী। জেলার ৩৬টি বিলুপ্ত ছিটমহলের ২০ হাজার মানুষের মুখে এখন শুধু একটি কথা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছায় আজ আমরা মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হতে পেরেছি। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। অবহেলিত ও উন্নয়নবঞ্চিত এসব জনপদে শুরু হয় সরকারের বিশেষ বরাদ্দে নানা উন্নয়নমুখী কাজ। সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তিন বছরে সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে এলাকার চিত্র, এখানে বসবাসকারী মানুষদেরও ভাগ্য পরির্তন হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাকা সড়ক আর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত সব গ্রাম। বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকরা শতভাগ বিদ্যুত সুবিধা পেয়েছে। পঞ্চগড় সদর, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার অভ্যন্তরে ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা গত ৩ বছর আগেও ছিল ভারতীয় ভূ-খ-। ৭৪-এর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর এসব ভূ-খ-ের মানুষ নাগরিকত্বহীন অবস্থায় বন্দীদশা জীবনযাপন করছিলেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা উভয় দেশের ছিটমহলগুলোর বিনিময় চুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়। ভারতের মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা-মোদি প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে শুরু হয় দু দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিকতা। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন হয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশী নাগরিক এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতের নাগরিক হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ঐতিহাসিক এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোকসজ্জা, ১ আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আনন্দ শোভাযাত্রা, শিশুদের খেলাধুলাসহ নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সদর উপজেলার বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলের রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রহিমা খাতুন বলেন, এক সময় আমাদের এলাকার রাস্তা দিয়ে ঠিকমতো হেঁটে চলা যেত না। আমাদের কোন স্কুলও ছিল না। মিথ্যা নাম পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশী স্কুলে লেখপড়া করতে হতো। এখন আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাই। স্কুল যাতায়াতের জন্য সাইকেলটিও দিয়েছে স্কুল থেকে। আমরা এখন নিজের স্কুলে লেখাপড়া করছি। প্রায় সত্তর বছর বয়সী বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহল এলাকার আনার আলী বলেন, আমাদের কোন মানুষের মর্যাদা ছিল না। এলাকায় কোন আইনকানুন ছিল না। একজন নাগরিক যে সকল সুবিধা পায় আমরা তা পেতাম না। আমাদের শিশুরা ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে ছিটমহলের পাশের স্কুলে লেখাপড়া করত। সন্ধ্যার পর একটু আলোর জন্য কুপিবাতি আর মোমবাতিই ছিল ভরসা। এখন এলাকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুতের আলো আমাদের জীবনযাপন বদলে দিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার আমাদের জীবনের অন্ধকার দর করেছেন। গারাতি ছিটমহলের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, তিন বছরে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে ছিটমহল এলাকায়। ছিটমহলের পাশে বাংলাদেশী এলাকার অনেক বাড়িতে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি। কিন্তু বিলুপ্ত ছিটমহলের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। উন্নত যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত সহায়তার ব্যবস্থায় আমরা এখন গর্বিত বাংলাদেশী নাগরিকের মর্যাদা জীবনযাপন করছি। কুড়িগ্রাম স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, আজ ১ আগস্ট। তিন বছর আগে ২০১৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মূল ভূ-খ-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় ভারতীয় ছিটমহলগুলো। ফলে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর কাছে এটা একটা বিশেষ দিন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তারা দিনটি পালন করছে। দিনের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যা ৭টায় আলোচনা সভা, রাত ৯টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ। দু দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের পর দিন থাকছে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আনন্দ র‌্যালি, ক্রীড়া অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার বিতরণ। অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে দেশের বৃহত্তম ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে। সাবেক ছিটমহলবাসী পক্ষে বিলুপ্ত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি আলতাফ হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খানসহ অন্য নেতারা অনুষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম মঞ্জু ম-ল, সাবেক এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী, ফুলবাড়ী আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান শেখ ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গোলাম মোস্তফা খান।
×