ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়েজিদ দৌলা বিপু

অভিমত ॥ মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১ আগস্ট ২০১৮

অভিমত ॥ মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস

মাদকের অনিয়ন্ত্রিত অবৈধ ব্যবহার এখন এক বৈশ্বিক সমস্যা। সমস্যাটি গভীর হচ্ছে। সমস্যাটির অভিঘাত শুধুমাত্র শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পদই বিনষ্ট করছে না, দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে তৈরি করছে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও সঙ্কট। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংঘটিত অপরাধ, অবৈধ অর্থপ্রবাহ, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের গোপন যোগসূত্র সক্রিয় হওয়ার ফলে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে বৈশ্বিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও শান্তি, যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগসমূহের একটি অন্যতম কারণ। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট ২০১৭ জানিয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত মাদক ব্যবহারের ফলে বিপন্ন হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এইচআইভি, হেপাটাইটিস ও যক্ষ্মার মতো মারাত্মক ব্যাধি বিস্তার লাভ করেছে। এ কারণে সারাবিশ্বে কমপক্ষে ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ অপরিণত মৃত্যুবরণ করেছে। এইচআইভি/এইডসের তুলনায় হেপাটাইটিস-সি রোগের নেতিবাচক অভিঘাত অনেক বেশি মারাত্মক হওয়ায় প্রতিবেদনটিতে উল্লিখিত রোগের চিকিৎসার অভিগম্যতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মাদকের অনিয়ন্ত্রিত অপব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। এর অভিঘাতে সংক্রমিত হচ্ছে রাজনৈতিক আচার-আচরণ এবং প্রভাবিত হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। মাদক সেবনের জন্য বাড়তি অর্থের যোগান দিতে সংঘটিত হচ্ছে মাদক কারবার, চোরাচালানী, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, দোকান লুট, খুন, ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা, পতিতাবৃত্তি, অপহরণ ও মুক্তিপণের মতো বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সঙ্কট মোকাবেলায় বাড়তি চাপ পড়ছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ বাহিনীর ওপর। মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। দুর্নীতির ফলেই সংঘটিত হচ্ছে মাদক সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের ‘সংঘটিত অপরাধ’, যা ড্রাগ সরবরাহ চেনের প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতির সুযোগ বিদ্যমান বলে দাবি করেছে মাদক বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন। ‘সংঘটিত অপরাধ গোষ্ঠী’ হলো তিন বা ততোধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী গড়ে ওঠা একটি কাঠামোভিত্তিক গোপন দল, যার লক্ষ্য অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আর্থিক এবং অন্যান্য বৈষয়িক সুবিধা অর্জন করা (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন এগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম-২০০০)। বহুজাতিক সংঘটিত অপরাধের মধ্যে মাদক চোরাচালানী অন্যতম। এই অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে চাষ করা আফিমের শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি উৎপাদিত হয় তালেবান প্রভাবিত এলাকায়। আফগানিস্তানে মাদক চাষ, উৎপাদন ও চোরাচালানীতে তালেবানী ভূমিকা উল্লেখ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক নথিতে বলা হয়, তালেবানদের বার্ষিক আয় আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন ডলার, যার অর্ধেকই আসে তাদের অবৈধ মাদক অর্থনীতি থেকে। তালেবান ছাড়াও বোকো হারাম ও আল কায়েদার মতো জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোও মাদক চোরাচালানীতে তৎপর রয়েছে বলে এসব নথিতে উল্লেখ করা হয়। প্রাপ্ত নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সংঘটিত অপরাধ ও সন্ত্রাসের মধ্যে যোগসূত্র এবং সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে তা স্থিতিশীল নয়, বরং মাদক বাজারের মতোই ‘বিবর্তনশীল’ বা পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মাদক সরবরাহ, চোরাচালানী রুট ও অপব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে গতি পাল্টাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তৈরি করছে বৈচিত্র্য। মাদক ব্যবসার মডেলও বদলাচ্ছে। এর একটি অন্যতম কারণ হলো অপরাধবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন। উদাহরণ হিসেবে ‘ডার্কনেট’ নামক নয়া ইন্টারনেট প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই প্রযুক্তির অপব্যবহার অবৈধ মাদক ব্যবসার প্রকৃতি বদলে দিচ্ছে। উল্লিখিত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সমান্তরাল নেটওয়ার্কভুক্ত অপরাধী ও ক্ষুদে গোষ্ঠীগুলোর ধরনও বদলাচ্ছে। একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংঘটিত অপরাধ নেটওয়ার্কভুক্ত অপরাধীচক্রের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস মাদক কারবার। ইওরোপোল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পাঁচ হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক সংঘটিত অপরাধসংঘ শনাক্ত করেছে এবং এদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মাদক চোরাচালানী কারবারে নিয়োজিত। এতে অন্যান্য অপরাধের তুলনায় মাদক চোরাচালানী অধিকতর ব্যাপ্তি লাভ করেছে। সংঘটিত অপরাধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্রমাধিকারতান্ত্রিক উল্লম্ব (ভার্টিক্যাল) নেটওয়ার্কগুলো বেশি সক্রিয়। তবে ইদানীং আনুভূমিক সমান্তরাল (হরিজেন্টাল) নেটওয়ার্কও বেশ গুরুত্ব ও তৎপরতা লাভ করছে। ইউরোপের সংঘটিত অপরাধচক্রের ৩০-৪০ শতাংশই এই নেটওয়ার্কভুক্ত বলে ইউরোপোল দাবি করেছে। মাদক চোরাচালানকারী মাফিয়াদের সাংগঠনিক কাঠামো বিষয়ে ইতালিতে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, অপরাধ বাজার পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্রমাধিকারতান্ত্রিক কাঠামোভুক্ত মাফিয়াচক্রের সদস্যরা তুলনামূলক স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। এই নেটওয়ার্কের মাফিয়া প্রধানরা থাকেন পর্দার অন্তরালে। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই তারা অপরাধ বাজার পরিচালনা করে থাকেন। মাদক চোরাচালানী কারবার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বেশি নির্ভর করেন মাফিয়াদের সামাজিক কাঠামোর ওপর। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, আচার-অনুষ্ঠান ও গোপনীয়তাভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর। এই সম্পর্ক কাঠামো তাদের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও সংহতি তৈরি করে বলে নিয়ন্ত্রণের তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ এতে অবৈধ ব্যবসার ঝুঁকি কম থাকে। পক্ষান্তরে, কেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্কে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রমাধিকারতন্ত্রে নমনীয়তার সুযোগ থাকে না বলে সংঘটিত অপরাধগোষ্ঠীদের জন্য তা উপযোগী নয় বলে জানিয়েছে গবেষণাটি। অবৈধ মাদক বাজারের প্রকৃতি গতিশীল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা বরং সুযোগ-অধ্যুষিত নমনীয় ঝুঁকি হ্রাস কৌশল গ্রহণও অনুসরণ করে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিপ্লব বৈশ্বিক উন্নয়নে অভিনবত্ব সৃষ্টি করলেও, ক্ষেত্রবিশেষে চোরাচালানীদের জন্য বয়ে এনেছে নতুন আশীর্বাদ। আশীর্বাদপুষ্ট সুবিধা গ্রহণ করে সরাসরি যোগাযোগের পরিবর্তে ‘ইনক্রিপটেড নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান করে খুব সহজে খদ্দেরদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয় তারা। ‘ডার্কনেট’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘বিট কয়েন’ ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার মাদক ক্রেতাদের জন্য নিরাপদ সুযোগ তৈরি করেছে। ‘ডার্কনেট’ এ্যাকাউন্টধারীদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সংখ্যা বেড়েছে বেশ দ্রুত। ইন্টারনেটের এরূপ প্রযুক্তিগত অপব্যবহার বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চোরাকারবার বাজারে দুর্বৃত্তায়নের ফলে মাদক একটি অবৈধ অর্থনীতির উত্থান ঘটায় বাজার অর্থনীতিতে শুরু হয় অশুভ প্রতিযোগিতা, সম্পদ মূল্য বেড়ে যায়, পরিলক্ষিত হয় অস্থিরতা, সঙ্কোচন ঘটতে থাকে বৈধ ব্যবসার এবং পরিশেষে, তার নিষ্ক্রান্তি ঘটে বাজার থেকে। চোরাকারবারী বাজার টিকিয়ে রাখতে অবারিত হয় দুর্নীতির দুর্গ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও তৈরি হয় এক ধরনের স্থায়ী বৈকল্য। মাদক বিক্রয়ের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অন্য দেশে পাচার হয়ে যায়। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওসিডি) পরিচালিত এক গবেষণা মতে, মানি-লন্ডারিংয়ে এক বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেলে সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.০৩ থেকে ০.০৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। তবে অন্য এক গবেষণা মতে, উল্লিখিত প্রবৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। সাম্প্রতিক বিশ্ব মাদক বিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের কারণে বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়, ফলে সঙ্কটাপন্ন হয় দারিদ্র্যাবস্থা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক গবেষণায় বলা হয়, দুর্নীতির কারণে যে আয় বৈষম্য তৈরি হয় তাতে উৎসাহিত হয় মাদক চোরাচালানী। এমন পরিস্থিতিতে মাদকদ্রব্যের অসংযত অপব্যবহার ও চোরাচালানী বন্ধ না হলে বা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, ড্রাগ শিল্প জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বৈষম্য তৈরি করতেই থাকবে। এই বৈষম্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও এই ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সম্প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্বের তালিকায় প্রবেশ করে বাংলাদেশ যে বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও সুনাম অর্জন করেছে, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে মাদকের অপব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহ নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই। লেখক : উন্নয়ন গবেষক [email protected]
×