ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেনজির আবরার

প্রবীণের পাশে তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ৩১ জুলাই ২০১৮

প্রবীণের পাশে তারুণ্য

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে কাজ করছে খুব কম সংগঠন। তবে এটাও ঠিক, প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজের মধ্যে বেরিয়ে আসছে নিত্যনতুন ধারণা। এমনই একটি ধারণা নিয়ে ২০১৬ সালের ২৫ জুন বৃদ্ধ মানুষের পাশে থাকাই আমাদের মূল লক্ষ্য এই স্লেøাগানে উজ্জীবিত হয়ে একদল তরুণ গড়ে তোলে ‘প্যারেন্টস এজিং ফাউন্ডেশন।’ প্রতিষ্ঠাতার নাম জি.এম.আদল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক তরুণ-তরুণীকে সংগঠিত করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু প্যারেন্টস এজিং ফাউন্ডেশন এর। মূল উদ্দেশ্য, প্রবীণ মানুষের অধিকারমূলক সচেতনতা বৃদ্ধি। এ ছাড়া তারা প্রবীণ এবং তরুণের মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপ কমিয়ে আনা, প্রবীণদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রবীণ বয়সে আর্থিক সঙ্কট দূরীকরণে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান, প্রবীণদের মানসিক সহায়তা, আপনজনকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রথা দূরীকরণ, নবীন-প্রবীণের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নেয়া, প্রবীণ মানুষের অধিকার রক্ষায় আইনী পরামর্শ প্রদান, বার্ধক্যের অবহেলা থেকে নিজেকে রক্ষায় নবীনদের আগাম প্রস্তুতির দিক-নির্দেশনামূলক পরামর্শ প্রদান এবং যুবসমাজ, নারী, পুরুষ, পরিবেশ এবং সমাজের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ সংগঠিত করে সমাজ এবং দেশের মানোন্নয়ন ঘটানো ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে। এ পর্যন্ত তারা বেশকিছু কাজ হাতে নিয়েছে তাদের লক্ষ্য পূরণে আর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে। বর্তমান সরকারের প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আদল জানালেন, ২০১৬ সালে ২৫ জন অসহায় বৃদ্ধ মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। উক্ত সময়ে আমরা ১০০ এর অধিক বৃদ্ধ মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ করি। পরবর্তী ২০১৭ সালেও অর্থাৎ এ বছর আমরা প্রায় ৩০০ এর অধিক বৃদ্ধ মানুষকে ইফতার করাতে সক্ষম হয়েছি। এরপর রয়েছে শীতবস্ত্র বিতরণ, এ পর্যন্ত ১০০০ এর অধিক অসহায় বৃদ্ধ মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। আমরা বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনও করেছি এর মধ্যেই। সমাজ সচেতনতার লক্ষ্যে এবং বৃদ্ধাশ্রমের করুণ পরিণতি মাঠ পর্যায়ে বিশ্লেষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে এই পরিদর্শন। পাশাপাশি, ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস উদযাপন করেন তারা, সংগঠনটির কর্মীরা ইতোমধ্যে ১০০০ এর অধিক জনকে রক্ত দিয়ে মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। বৃদ্ধ মানুষের জন্য ফ্রি হেলথ ক্যাম্পেইন করেছেন তারা, যার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ১৫০০ এর অধিক বৃদ্ধ মানুষকে স্বাস্থ্য সহায়তা দিতে সক্ষম হয়েছেন। এটি তাদের একটি চলমান প্রকল্প। বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে কাজ করার রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পগুলোর অবস্থা কেমন তা আদলের কাছে জানতে চাইলে। তিনি কয়েকটি প্রকল্পের উদাহরণ দেন। উদাহরণ ১ এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ : পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়া উপজেলার বিধবা দিপালী রানী, বয়স ৭৫ বছর। ২৫ বছর আগেই স্বামী মারা গেছেন। এরপর পালাক্রমে আট সন্তানেরও মৃত্যু হয়েছে। এখন পৃথিবীতে কেউ নেই এই অভাগী মায়ের। এমন সঙ্কটময় জীবনে ৭৫ বছরের এই বৃদ্ধা মা ভিক্ষার করুণায় বাঁচতে চান না। তিনি ৬৮ নম্বর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে চকোলেট বিক্রি করে দৈনিক ২০-৩০ টাকা আয় করেন, মাঝে মাঝে আয় হয় না। এতে তার খাবারই হয় না, এ অবস্থায় তার জীবন সঙ্কটাপন্ন। দীপালি রানীর কথা জানতে পারি আমরা। শুরু হয় তাকে নিয়ে উদাহরণ- ১ এর প্ল্যান। গত ২৬ জুন ২০১৭ তারিখে আমাদের প্যারেন্টস টিম তার হাতে তুলে দেয় দোকানের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মালামাল, বিধবার পরিধেয় ২ খানা শাড়ি, তেল-সাবান, আয়না, চিরুনি, ব্যাগ, জুতা, ছাতা এবং নানা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। উদাহরণ-২ এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ : গিয়াস উদ্দিন; জন্ম : ৪ আগস্ট ১৯৫৮, ৩ ছেলে, ১ মেয়ে। কেউই সঙ্গে থাকে না। ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও কেউই অসহায় বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ায় না। তাই এখন থেকে আমরা চধৎবহঃং অমবরহম ঋড়ঁহফধঃরড়হ আছি এই অসহায় প্রবীণের পাশে। প্রজেক্ট উদাহরণ-২ তে আমরা গিয়াস উদ্দিন চাচার ‘টি স্টল’ শুরু করতে পেরেছি। উদাহরণ ৩ এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ : বালিগাঁও, কিশোরগঞ্জের আব্দুল কাদের , পিতার নাম : বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মহরম আলী, বর্তমান ঠিকানা : বলাকা মোড়, তেজগাঁও, ঢাকা। লোকটি মধ্যবয়সী, বয়স ৫০ বছর। তিনি তিন কন্যাসন্তানের জনক। তার কোন ছেলে নেই। আগে ভালই ছিলেন। নিজের খাবারের গাড়ি ছিল। সংসার ভালভাবেই চলছিল। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলেন। কিছুদিন আগে ওনার বড় মেয়ের একটা বড় অপারেশন হয়। যার কারণে ওনাকে সবকিছু বিক্রি করে দিতে হয়। বর্তমানে উনি অন্যের গাড়ি দৈনিক ভাড়ায় নিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। যা দিয়ে তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা দুঃসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলেও কোথাও কোন সুযোগ-সুবিধা পাননি। মানবতার দিক বিবেচনা করে প্যারেন্টস এজিং ফাউন্ডেশন তাকে একটি ফুড কার্ট করে দেয়, যার নামকরণ করা হয়েছে প্যারেন্টস এক্সপ্রেস। প্যারেন্টস এজিংয়ের আরেকটি কাজ হচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমের অথবা হারিয়ে যাওয়া প্রবীণদের খুঁজে ঘরে পৌঁছে দেয়া। আর প্রযুক্তি ব্যবহারে শুধু নবীনরা নয়, প্রবীণরাও পারদর্শী হবেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষা নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত প্রবীণদের তারা উৎসাহিত করছেন।
×