ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থানে ভারতীয় নারীরা অনেক পিছিয়ে

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৩১ জুলাই ২০১৮

কর্মসংস্থানে ভারতীয় নারীরা অনেক পিছিয়ে

হিন্দুধর্মে লক্ষ্মী হচ্ছে সম্পদ ও ঈশ্বর্যের দেবী। কিন্তু ভারতের নারীদের মধ্যে আজকের বাস্তব জীবনে লক্ষ্মীর কোন প্রতিচ্ছবি নেই। থাকবেই বা কি করে। সৌদি আরব বাদে জি-২০ এর যে কোন দেশে নারীরা যে পরিমাণ অর্থনৈতিক কাজকর্ম করে থাকে ভারতীয় নারীরা করে তার চেয়েও কম। দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনের এক ষষ্ঠাংশ যোগায় নারীরা যা বৈশ্বিক গড়ের অর্ধেক। অথচ গত দুই দশক ধরে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বছরে প্রায় ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এখনকার মেয়েরা তাদের মায়েদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত। এমন অবস্থায় অন্যান্য গরীব দেশের শ্রমশক্তির বাজার লাখ লাখ মহিলাকে টেনে নিয়েছে। কিন্তু ভারতের বেলায় ঠিক তেমনটি হয়নি। ভারতকে বাদ দিয়ে বিশ্বব্যাপী কর্মজীবী মহিলার সংখ্যানুপাত ৫০ শতাংশ। কিন্তু ভারতে এই সংখ্যা ২০০৫ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ আজ তা হ্রাস পেয়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কোন দেশে এভাবে এত ব্যাপক পরিসরে হ্রাস পায়নি। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ যা শীঘ্রই এক নম্বরে স্থান পেতে যাচ্ছে। অথচ শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের দিক দিয়ে ভারতের অবস্থান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর হিসাবে ১৩০টি দেশের মধ্যে ১২১তম। সারা বিশ্বে মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার পুরুষদের সমান হতে হলে আরও ৭০ কোটি মহিলাকে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। এদের এক-তৃতীয়াংশ বা ২৩ কোটি ৫০ লাখ হতে হবে ভারতীয়। ভারত যদি ২০০৫ সালের হারও বজায় রাখত তাহলে ইতোমধ্যে আরও ৪ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে যোগ দিত। প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় নারীর শ্রমে অংশগ্রহণ হ্রাস পেল কেন। কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে হ্রাস পাওয়াটা অগ্রগতির লক্ষণ, মেয়েরা শিক্ষালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে শ্রমশক্তির বাইরে দীর্ঘক্ষণ থাকছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে দুই অবাঞ্ছিত প্রবণতার ফল। পরিবারগুলো যত বিত্তশালী হচ্ছে ততই তারা মেয়েদের বাইরে কাজ করা বন্ধ রাখতে বেশি পছন্দ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয় যে, মেয়েদের ঘরের মধ্যে রাখলে পরিবারগুলো তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ে বলে মনে করে। তবে ভারতে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে। কম-বেশি একই রকম আয় স্তরে থাকা অন্য দেশগুলোর চেয়ে ভারতীয় নারীদের শ্রমে অংশগ্রহণের হার বেশ কম। ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধান বর্তমান। ১৫ থেকে ২৪ বছরের প্রায় ৪৯ শতাংশ মহিলা শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণে নেই সেখানে ওই বয়সের মাত্র ৮ শতাংশ ছেলে এসবে যুক্ত নেই। সুতরাং মেয়েরা শিক্ষাঙ্গনে অধিক সময় থাকছে এবং সেই কারণে শ্রমের বাইরে থাকছে এটা এক দিক দিয়ে সুসংবাদ হলেও একটা হেঁয়ালি ব্যাপার হলো বর্তমান ভারতে মেয়েরা যত বেশি লেখাপড়া করছে দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কাজ করার সম্ভাবনা কমছে। সমাজের নিরক্ষর মহিলা যারা প্রায়শই দরিদ্রতম অংশ থেকে আগত তাদের কাজ করার বিকল্প বলতে গেলে নেই। অধিকাংশই কৃষি মজুরের কাজ করে। ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী গ্রামে থাকে এবং সেখানকার অর্ধেকেরও বেশি নারীর কর্মসংস্থান হয় কৃষিতে। পরিবারের আয় বাড়লে মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পায়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ হলে তাদের গায়ে গতরে খাটার কাজ বাদ দিয়ে সংসার সামলানোর কাজে লাগানো হয়। শহর-নগরের ক্ষুদ্র এলিট শ্রেণীর বাইরে মহিলাদের অবস্থা হচ্ছে কাজ না করা যদি না পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর অন্য কোন উপায় থাকে। একটা পরিবারের সামাজিক মর্যাদা অংশত আসে নারীদের সংসারের মধ্যে রেখে দেয়ার ওপর। সুতরাং মহিলারা কর্মজীবী কিনা তা নির্ভর করছে পরিবারের আয়ের ওপর। এক্ষেত্রে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্য পার্থক্য আছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকায় পুরুষরা যেখানে স্ত্রীদের রেখে শহরে কাজ করতে যায় সেখানে মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। পাঞ্জাব এবং বেশিরভাগ জনবহুল ও রক্ষণশীল হিন্দু অঞ্চলে এই হার ১৫ শতাংশের কম। শহরের বাইরের মহিলারা সে সংখ্যায় কাজে নিয়োজিত শহুরে মহিলাদের সংস্থা তার অর্ধেক। তবে গ্রামীণ মহিলাদের শ্রমে অংশগ্রহণ হ্রাস পাওয়ায় এই ব্যবধান কমছে। ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে শ্রমশক্তিতে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণের হার ৪৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। শহর এলাকায় এই হার প্রায় ২০ শতাংশেই রয়ে গেছে। তবে শহরমুখী মানুষের ঢল ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় শ্রমে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। কাজ করতে আগ্রহী মেয়েদের প্রচুর বাধাবিঘেœর সম্মুখীন হতে হয়। পরিবারের বাধা তো আছেই। অনেকে নানা ধরনের পেশা শেখার মাঝখানেই ছেড়ে দেয় পরিবারের দাস-দাসিত্বের কারণে। বিবাহ অনেক মেয়ের ক্যারিবিয়ারকে অঙ্করেই বিনষ্ট করে দেয়। ভারতে ১০টি বিয়ের ৯টি হয় পারিবারিক আয়োজনে। এমন বিয়ের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মেয়ে তার বিবাহপূর্ব চাকরি বা পেশা অব্যাহত রাখার সুযোগ পায়। বিবাহিত নারীরা বাইরে কাজ করবে না এমনটাই প্রত্যাশিত। ভারতীয় তরুণদের ৪১ শতাংশ মনে করে যে বিবাহিত নারীদের কাজ না করাই ভাল। অথচ মহিলারা ঘর সংসারের যাবতীয় কাজকর্মের ৯০ শতাংশই করে। এই অনুপাত বিশ্বে সর্বোচ্চ। এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টা সময় চলে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে চাকরি করা বা করানোর যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে মেয়েদের স্কুলে লেখাপড়া শেখানো কেন? এর জবাব, মেয়েদের লেখাপড়া শেখালে বিয়ের সময় যৌতুক লাগে না বা লাগলেও কম লাগে। ‘হাফ এ বিলিয়ন রাইজিং : দি ইমারজেন্স অব ইন্ডিয়ান উইমেন’ গ্রন্থের লেখক অনুরুদ্ধ দত্ত বলেছেন যৌতুক নিষিদ্ধ হলেও গড়ে ৩৫ হাজার রুপি বর পক্ষকে দেয়া এক রেওয়াজ হিসেবে রয়ে গেছে। এটা মধ্যম আয়ের পরিবারের বার্ষিক আয়ের প্রায় অর্ধেক। স্কুলে মেয়েদের লেখাপড়া করানো গ্রামীণ সমাজে যৌতুকের অঙ্ক কমানোর একটা ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়। তবে অনেক মহিলাই যে কাজ করতে চায় তার তথ্য প্রমাণ আছে। দেখা গেছে বাড়িতে থাকা ৩১ শতাংশ মহিলা বাইরে কাজ পেলে কাজ করবে। সুযোগ থাকলে তারা সেটার সদ্ব্যবহার করে থাকে। সরকারের এক স্কিমে গ্রামীণ মহিলাদের বছরে ১০০ দিন অর্থের বিনিময়ে শ্রমের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের শ্রমে অংশগ্রহণ বেড়েছে। মাঝারি স্তরের শিক্ষিত মহিলাদের চাকরির সুযোগ যে অবারিত তা নয়। প্রতি মাসে ভারতের শ্রমবাজারে প্রায় ১০ লাখ নতুন শ্রমিকের আগমন ঘটছে। এটা নারী ও পুরুষ মিলিয়ে। তবে তাদের চাকরির বাজার অতি সীমিত। সম্প্রতি রেলওয়েতে ৯০ হাজার লোক নেয়ার এক বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। প্রার্থীর সংখ্যা ছিল আড়াই কোটি, নারী চাকরির প্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা যে পুরুষদের মতো একই রকম তা নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউএর ২০১২ সালের এক রিপোর্টে বলা হয় ৮৪ শতাংশ ভারতীয় স্বীকার করেছে যে চাকরির সংখ্যা এতই কম যে মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের চাকরি পাওয়ার অধিকার বেশি। বস্তুত পক্ষেই চাকরির বাজারে পুরুষদেরই দাপট। এই ধারাটি ভারতের অর্থনীতির প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান। মেনু ফ্যাকচারিং খাতের শ্রমিকদের এক-চতুর্থাংশেরও কম মহিলা যেখানে চীনে প্রায় অর্ধেক। ব্রাজিলে সার্ভিস খাতের ৫১ শতাংশ মহিলা। আর ভারতে মাত্র ১৯ শতাংশ। সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য সেবা কর্মীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মহিলা। ভারতে অর্ধেকেরও কম। আরও খারাপ কথা হলো ভারতে অর্থনীতির প্রসার ঘটাতে গিয়ে তা নারীবান্ধব খাতগুলো থেকে সরে গেছে সেই সব খাতে সেখানে পুরুষদের প্রাধান্য। কৃষি খাতে ট্রাক্টরসহ যান্ত্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ায় কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা কমে গেছে। ২০০৫ সালে সেখানে এই সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি এখন তা থেকে সাড়ে তিন কোটি কমে গেছে। কর্মহারা এই শ্রমিকদের সিংহভাগ মহিলা। একই সময় শিল্পে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ। কৃষিখাতে বেকার হয়ে পড়া সবাইকে নিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্টÑ তা সে নারী হোক আর পুরুষ হোক। কিন্তু বাস্তবে পুরুষরাই এর ৯০ শতাংশ চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। একই সময় সার্ভিস খাতে সৃষ্ট সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি চাকরির ৮০ শতাংশই পেয়েছে পুরুষরা। বেতন স্কেলে প্রায় শীর্ষ স্তরের কাছাকাছি আইটি সেক্টরের চাকরিগুলো মোটামুটি নারীবান্ধব। কিন্তু বড় কোম্পানিগুলোর অটোমেশনের চাপে এই খাতে কর্মসংস্থানও থমকে আছে। অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশে যেসব শিল্পে লাখ লাখ নারীর চাকরির সংস্থান হয় ভারতে তা বহুলাংশে অনুপস্থিত। পুরনো শ্রম আইন এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সরকারের হয়রানি করার প্রবণতার কারণে আইকোন বা টি-শার্ট উৎপাদনকারী মেগা ফ্যাক্টরি সেখানে গড়ে উঠছে না। ভিয়েতনাম ও ইথিওপিয়ায় প্রচুর মেগা ফ্যাক্টরি আছে যেখানে মহিলারা শ্রমে নিয়োজি হয়ে কাপড় ও জুতা উৎপাদন করছে। এর ফলে নারী শ্রমের অংশগ্রহণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। নারীদের কাজ না দিতে পারার ফলে ভারতের অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ছে। অথচ নারীরা ব্যাপক পরিসরে শ্রমে অংশ নিলে দেশটি ২৭ শতাংশ বেশি ধনী হতে পারত বলে আইএমএফ হিসাব করে ফেলেছে। নারীদের শ্রমে অংশগ্রহণ সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে নারী ও পুরুষর মধ্যে সম্পদের বণ্টনের ওপরও প্রভাব পড়ছে এবং সমাজে নারীরা যথার্থ ভূমিকা পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×