ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সুরমা কীর্তনখোলার তীরে উৎসব আজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩০ জুলাই ২০১৮

  পদ্মা সুরমা কীর্তনখোলার তীরে উৎসব আজ

পদ্মা নদীতে বোটে চড়ে পাড়ি দিতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। আর জাতীয় কবি নজরুল তো গেয়েই উঠলেন, ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যারে।’ পদ্মার ভাঙা গড়ার খেলায় নদী সিকস্তি মানুষেরা গড়ার পালায় চরে আবার বসতি ঘরে। সেই পদ্মা তীরের শহর রাজশাহী, সেখানকার সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভোটের বাদ্যি শুধু শোনা গেছে এতদিন। এখন ভোটদান পর্ব। আজ সারাদিন নগরবাসী ভোটের আমেজে উৎসবের আবাহনে মেতে উঠছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে সংঘাত, সংঘর্ষ, হানাহানি যেন না ঘটে, সেজন্য সতর্ক অবশ্যই আমজনতা থেকে প্রশাসন। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে আজ কসুর করছেন না। নির্বাচনী পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার কাজটি আজ ভোটারদের যেমন, তেমনি রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রার্থীদের। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদেরও। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে আনন্দঘন। প্রতিফলিত হতে পারে জনমত। সুরমা নদীর জল টলমল করছে। সেই কবে লোকগায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী ভাটিয়ালি গানে ভরে তুলেছিলেন নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে জীবনের দ্যোতনায় এক স্বর্গীয় আস্বাদন। ‘ভাটির গাঙে ভাইট্যাল সুরে কে বাজায় বাঁশি’ বলে যখন গলা ছেড়েছিলেন, তখন রূপালী বাতাসের দোলা জেগে ওঠেছিল সমজদারের অন্তরে। হযরত শাহজালাল আর হযরত শাহ পরানের পবিত্র মাটির মানুষের চেতনায় আধ্যাত্মিকতার পরশ জাগে আর হৃদয়ের বীণায় বেজে ওঠে ‘সোহাগ চাঁদ বদনি ধনি নাচো তো দেখি’ কিংবা ‘আজি ভালো করিয়া বাজাও গো দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে।’ সে এক ধ্বনিময় সুরময় রসমাতুর্যে ভরপুর জীবনধারা জেগে ওঠে। সুরমা তীরের সিলেট নগরী উৎসবের আমেজে মাতোয়ারা আজ। প্রবাসী তথা লন্ডনে বসবাসকারী সিলেটিরা স্ব-ভূমিতে এসেছে এই উৎসবের টানে। যত দূরেই থাক, সিলেটের মানুষের মধ্যে মাটির টান তীব্র। তাই পালা-পার্বণে, নির্বাচনী আমেজ থেকে দূরে সরে থাকতে পারে না কোনভাবেই। এখানকার সংস্কৃতি হচ্ছে সবাই মিলেমিশে রাজনীতি করেন। যার যার ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রয়োগ করেন। নির্বাচন ঘিরে একদল আরেক দলকে ঘায়েল করবে, নেতাকর্মীরা বাসাবাড়িতে ঘুমাতে পারবে নাÑ এমন পরিবেশের সঙ্গে তারা পরিচিত নন। এখানকার সাধারণ মানুষ বড় বিচারক। ভোট কেন্দ্রে তারা সঠিক রায়ই প্রদান করে আসছেন। সেই ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ কালে গণভোট হয়েছিল সিলেটে। এই অঞ্চলটি পূর্ববঙ্গ না আসামের সঙ্গে যাবে, সে নিয়ে গণভোট হয়েছিল। সেই গণভোটে সারা বাংলায় আলোড়ন ঘটেছিল। গণভোটে শ্রীহট্ট তথা সিলেট পূর্ববঙ্গের সঙ্গেই মিলিত হয়েছিল দেহের কিছু অংশ ছাড় দিয়ে হলেও। সুরমা তীরের সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আজ ভোটাররা তাদের রায় দেবেন। নির্বাচন করবেন তাদের প্রতিনিধি। অবশ্য এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্য অতীতের নির্বাচনকালে যে হাঙ্গামা, হানাহানি, সংঘর্ষ হতো এবার সেসবের বালাই দেখা যায়নি। এবার সরকার দলীয় প্রার্থীর একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এই অঞ্চলে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রভাব রয়েছে। সন্ত্রাসী ঘটনায় তারা সিদ্ধহস্ত। তাই আশঙ্কা রয়ে যায়, এরা কোন অঘটন ঘটাবে কিনা। এদের সঙ্গে বিএনপির আঁতাত ও সখ্য রয়েছে। কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে অনেক অঘটন ঘটাতে পারে। এমন আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। সংঘাত, হাঙ্গামা ঘটাতে এরা আইন লঙ্ঘন করতে পিছ পা নাও হতে পারে। নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থীই জিততে চান। তাই রাজনৈতিক ফায়দা নিতে কেউ কেউ ছোটখোটো ঘটনাকেও বড় করে দেখাতে চাইবেন। এমনিতে সিলেটের মানুষ শান্তি শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব অভিযোগ গত ক’দিনে তোলা হয়েছে, তা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। অবশ্য এটা বিশ্বাস করেন এই অঞ্চলের প্রার্থী ও ভোটাররা। যে ভোট দেবে জনগণ। তাই জনগণের ওপর আস্থা রাখা উচিত। সিলেট সামাজিক সম্প্রীতির অঞ্চল, রাজনৈতিক সহমর্মিতায় বিশ্বাসী বলে সংঘর্ষের আশঙ্কা কম। গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু হয়। তবে নিয়ম ভঙ্গ করে অনেক প্রার্থীই শহর উপকণ্ঠে গিয়ে সভা-সমাবেশ করেছে। প্রচারে কোন প্রার্থীই নেই পিছিয়ে। বরিশালে বড় ধরনের কোন অঘটন ঘটেনি, হামলা-মামলা কিংবা গণগ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেনি প্রচারে। উল্লেখ করার মতো তেমন কোন অভিযোগও করেননি প্রার্থীরা। নদী-বিল-খাল; এই তিনে বরিশাল, বাংলাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ অঞ্চল। কবি জীবনানন্দ দাশ কীর্তনখোলা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন, ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানার চিল। শঙ্খচিল, গাঙচিল, শালিকের আনাগোনা। দেখেছিলেন বাংলার মুখ। তাই এই বাংলা ছেড়ে আর কোথাও যাবার সাধ জাগেনি। রূপসী বাংলার কবির বরিশাল খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। রবীন্দ্রনাথও বরিশাল এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেখানকার মানুষ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারবেন, এমন প্রত্যাশায় গোড়া থেকেই করে আসছেন। তারা জানেন, এটি কোন সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়। সেøাগান উঠেছে ‘সুষ্ঠু হবে নির্বাচন’। নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হবে বলে বিশ্বাস করেন এখানকার ভোটাররা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ছোটখাটো ঘটনায়ও দলীয় প্রার্থীদের কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর। শাসানো হয়েছে। জরিমানাও করা হয়েছে। গণহারে গ্রেফতার, হামলা, মারধর কিংবা প্রচারে বাধা দেয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। তাই ভোটাররা শঙ্কামুক্ত যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। শঙ্কার কোন কারণও দেখানো যাচ্ছে না। এই পরিবেশ অস্বাভাবিক করার মতো লোকের অভাব নেই। সব দলেই কিছু লোক থাকে যারা অতি উৎসাহী হয়ে সুষ্ঠু পরিবেশকে ঘোলা করার চেষ্টা চালাতে পারে। শ্রাবণের ঘনঘটা বর্ষণমুখর দিনে ভোট হচ্ছে দেশের তিনটি অন্যতম বড় শহরে। রোদ-বৃষ্টি ভেজা সময়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পাড়া-মহল্লা, ওয়ার্ডে নারী-পুরুষরা নেমেছিল। পোস্টার, লিফলেটে প্রায় সকল প্রার্থী নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সিটির উন্নয়নে, নগরবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনে। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হতে পারে সেজন্য নির্বাচন কমিশন সতর্কতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারে সেই প্রচেষ্টা চালাতে বদ্ধপরিকর। খুলনা ও গাজীপুরের সিটি নির্বাচন যেভাবে সংঘাতমুক্ত, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে সেই ধারা বজায় রাখার জন্য এই তিন সিটিতে সক্রিয় থাকবে, এমন প্রত্যাশা সবার। নির্বাচন কমিশন তিন সিটির ভোটারদের কাছে মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছেÑ যাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে হবে এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন সামাজিক, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠনও নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কোন কাজে এসব সংগঠনের কর্মীরা অংশ নেয়নি। বরং সতর্ক থেকেছে। নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে সচেষ্ট নিশ্চয় নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই তিন সিটির নির্বাচন তাদের জন্য ড্রেস রিহার্সেল বলা যায়। তিন সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের আস্থার স্থানটিকে আরও ঋদ্ধ করতে চায়। তাই নির্বাচনে অংশ নেয়া সব প্রার্থীকেই সমান চোখে দেখছেন তারা। কাউকেই ছাড় দেয়নি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে। সরকারী দলের প্রার্থীকেও কারণ দর্শাতে তারা পিছপা হয়নি। বিরোধী দলের প্রার্থীরাও তেমন কোন অভিযোগ তুলে ধরতে পারেনি; যাতে নির্বাচন ভ-ুল হয়ে যেতে পারে, একপেশে হতে পারে। ভোটদাতারা অনুকূল থাকলে তাদের প্রার্থীরা পরাজিত হবেন না; এমন বিশ্বাস জোট বিরোধীদলের প্রার্থীদের মধ্যেও দেখা গেছে। সরকারী পক্ষও সর্বান্তকরণে চায় তিন সিটি নির্বাচন হোক বিতর্কমুক্ত। তাই অত্যুৎসাহী দলীয় নেতা-কর্মীদের সংযত রাখা হয়েছে। পদ্মার ঢেউ এসে ভোটারদের মধ্যে নতুন জাগরণ তৈরি করছে। তাই আজ তারা ‘শঙ্খচিলের ভাসিয়ে ভেলা পদ্মাতে হই মাঝি’ গেয়ে ভোট দিতে উৎসাহ হতেই পারে। নির্বাচন স্থানীয় সরকারের হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তার একটা মহড়া হয়ে যাচ্ছে আজ। তিন সিটিতেই মেয়র পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীরা হাঙ্গামা থেকে সহজে বিরত থাকতে চাইবে না। অতীতেও এমনটাই ঘটছে। প্রচার যা-ই হয়েছে, আজ তার প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে। ‘ভোটারের মন বোঝা সহজসাধ্য নয়। শ্রাবণের মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে কোথায় ঝুপ করে পড়বে কেউ জানে না। কার নামের পাশে চিহ্ন দেবে আগাম বোঝাও দুঃসাধ্য। ভোটাররা তাদের জন্য কাজ করবেনÑযিনি সেই প্রার্থীকেই সাধারণত ভোট দেবেন, দিয়ে থাকেন। দলীয় নেতাকর্মীরা নির্দলীয় ভোটাররা যাতে তাদের ভোট দেয়, সে লক্ষ্যে কাজ করেছেন। আজ তিন শহরে ভোট উৎসব চলছে। এই উৎসব যেন ম্লান না হয়, সে জন্য সবার আগ্রহ থাকবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও কর্মীরা সতর্ক থাকবেন নিশ্চয়, নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। ভোট উৎসব চলছে তিন নদী তীরে আজ। নদীপারের মানুষ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবে গুরুত্ব দেবেনÑ এমনটা দেশবাসীও চায়।
×