ক্রমশ সঙ্কুুচিত হয়ে পড়ছে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মনোজগত, বিশেষ করে রাজধানী ও বড় বড় শহর-নগরে। খেলাধুলা বিশেষত বাইরের খেলাধুলার সঙ্গে পরিচয় ও চর্চা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি ও উচ্চতা। দখলদারদের দৌরাত্ম্যে রাজধানীর ফুসফুস বলে খ্যাত পার্কগুলো এবং ধমনী ও শিরা হিসেবে বিবেচিত খালগুলোর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। আগে ছোট-বড় সব স্কুলে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ ছিল। সে সব স্থানে এখন গড়ে উঠেছে বড় বড় বিল্ডিং। শিক্ষাঙ্গন সম্প্রসারিত হলেও সঙ্কুচিত হয়েছে খেলাধুলা ও বিনোদনের জগত। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সরকারী স্কুলগুলোর মাঠগুলোও বেদখলে অথবা ব্যবহৃত হয় অন্যবিধ কাজে। ফলে স্কুলগামী শিশুরা নিতান্তই ঘর তথা ফ্ল্যাটবন্দী হয়ে পড়েছে। একদিকে পিঠে ভারি বইয়ের বোঝা, অন্যদিকে প্রবল কোচিংয়ের চাপ। অতঃপর কোথায় যাবে এসব কচিকাঁচা? পড়ালেখা ও নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষার বাইরে যেটুকু সময় পায় শিশুরা, তাদের সময় কাটে টেলিভিশন দেখে অথবা কম্পিউটার কিংবা সেলফোনে গেম খেলে। কিন্তু সেখানেও কি শিশুরা প্রকৃতপক্ষে বিনোদন কিংবা শিক্ষামূলক কিছু আদৌ পাচ্ছে? এ বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বৈকি। বাস্তবে খেলাধুলা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভূত সহযোগিতা করে থাকে। দুঃখ, বিষণœœতা থেকে দূরে থাকতেও সাহায্য করে বৈকি। খেলাধুলার অভাবে সেই শিশুরাই বর্তমানে হয়ে পড়েছে আত্মমগ্ন ও আত্মকেন্দ্রিক। দেশের ৪০ শতাংশ শিশু এহেন প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠছে প্রায় বিকলাঙ্গ একটা গোষ্ঠী হিসেবে। ঢাকা দক্ষিণে ৩১টি এবং উত্তরে ৫৪টি খেলার মাঠের কথা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে এসবের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রে খেলাধুলার পরিবেশ নেই।
অবশ্য শহর-নগরের পাশাপাশি গ্রামের অবস্থাও যে ভাল এমন বলা যাবে না। এক সময় বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিল ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মন্ডিত। প্রায় গ্রামেই ছিল ছোট-বড় খেলার মাঠ ও গোচারণ ভূমি। প্রবল জনসংখ্যার চাপে খাদ্য সমস্যা মোকাবেলায় ধানচাষে মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগী হওয়ায় এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছে উদ্ধৃত্ত জমি ও বাথানে। এর পাশাপাশি বিদ্যুতসহ প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গ্রামগুলোতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বড় বড় দালান-কোঠা এবং ছোট-বড় শিল্প-কারখানা প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে সেখানে। ফলে গোচারণ ভূমি এবং খেলার মাঠ বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। তাই বলে এখনও যে কিছু অবশিষ্ট নেই তা নয়। উপজেলা সদর এবং বড়সড় গ্রামগুলোতে তো আছেই। আছে সরকারী খাসজমিও। সেসব সংরক্ষণ করে নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করা গেলে গ্রামের মানুষের একটি বিশুদ্ধ বিনোদনের ব্যবস্থা হতে পারে। ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হকি এমনকি হ্যান্ডবল খেলার জন্য তেমন ব্যয়বহুল উপকরণের প্রয়োজন পড়ে না। তদুপরি গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কানামাছি ইত্যাদি চিরায়ত লোকায়ত খেলাধুলা তো আছেই। উদ্যোক্তার অভাবও হবে না। কেননা অনেক গ্রামেই ছোট-বড় শিল্পপতি এবং প্রবাসী আয় আছে। গণমানুষকে নিয়মিত বিভিন্ন খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করা গেলে নির্মল আনন্দ-বিনোদনের পাশাপাশি সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-মাদক ইত্যাদির ছোবল থেকে সুরক্ষা সম্ভব হয় তরুণদের। এতে করে নতুন নতুন প্রতিভাও উঠে আসবে সুনিশ্চিত। নাগরিক জীবনে ব্যস্ততার কারণে অনেকেই যেতে পারেন না মাঠে। দর্শকখরাসহ সময় সময় টিকেট সঙ্কট-কালোবাজারি-মারামারি এমনকি বাজি ধরার খবরও মেলে। এসব অপবাদ ও কালিমা থেকে মুক্তি দিতে নানা ধরনের খেলাধুলা ছড়িয়ে দেয়া হোক চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, রংপুরসহ দেশের সর্বত্র। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সুনিশ্চিত করতে খেলাধুলাসহ নির্মল বিনোদনের কোন বিকল্প নেই।