ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ

শেখ হাসিনা পরীক্ষা সংস্কারে পথ দেখাবেন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ জুলাই ২০১৮

শেখ হাসিনা পরীক্ষা সংস্কারে পথ দেখাবেন

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ যে বেড়েছে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। তবে শিক্ষার লক্ষ্য কি, কার জন্য কোন্ শিক্ষা প্রযোজ্য, শিক্ষার বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য কোথায় অগ্রাধিকার দিতে হবে, শিক্ষার্থীকে কখন কোথায় কিভাবে পড়াতে হবে এবং যা পড়ানো হলো সে তার কতটা নিতে পারল এবং তার লেখাপড়া তাকে কতটা স্বাবলম্বী করতে পারল, পরিবার, সমাজ ও দেশ তার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করতে পারেÑ এসব নিয়ে সকলে একরকম অথবা একভাবে ভাবেন না। সকলে ভাবতেও চান না। তবে দুটো বড় পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসির ফল বের হলে অনেকে মতামত দেন, মন্তব্য করেন। ফল ভাল হলে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা সন্তোষ প্রকাশ করেন। খারাপ হলে ক্ষুব্ধ হন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে এ অবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এখন অনেকে খোলামেলা মতামত দিচ্ছেন। এদের মধ্যে পরীক্ষার্থী, পরীক্ষার্থীর অভিভাবক, পাঠদানকারী শিক্ষক যেমন আছেন, স্কুল-কলেজে পাঠদান করেন না, উচ্চশিক্ষা স্তরে পড়ান এমন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদও আছেন। ১৯ জুলাই এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকে তাদের বিভিন্ন মত ও মন্তব্য এখনও প্রিন্ট মিডিয়ায় অব্যাহত আছে। এবার আলোচনা-সমালোচনার বেশির ভাগ জুড়ে আছে পাসের হার কমে যাওয়া, ইংরেজী ও আইসিটিতে পরীক্ষার্থীদের খারাপ ফলের সঙ্গে কোন্ কোন্ কলেজে ভাল ফল হয়েছে, কোন্ কোন্ প্রতিষ্ঠানে কম পাস করেছে অথবা আদৌ করেনি এমন প্রসঙ্গ। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের সরকারী ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতারা পরীক্ষার ফল নিয়ে আলোচনার মধ্যে নেই। সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদে মতাদর্শ নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতা অথবা জনপ্রতিনিধিরা স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে আগ্রহী থাকলেও পাবলিক পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্তব্য করতে অভ্যস্ত নন। কথাটা অপ্রিয় হলেও বাস্তবতা এই যে, নিজের দল ক্ষমতায় থাকলে শিক্ষার উন্নয়নে দেশ কত এগিয়ে গেছে তার ফিরিস্তি দিতে তাদের ভুল হয় না। কিন্তু দল সরকারের বাইরে থাকলে শিক্ষার ভাল দিকগুলো, সঙ্কট এবং সঙ্কট উত্তরণে করণীয় নিয়ে বলতে কমই শোনা যায়। ব্যতিক্রম শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থাকতে পরীক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যেমন পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন, শিক্ষার কাক্সিক্ষত অগ্রগতিতে অবদান রাখেন- ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা আছে ক্ষমতায় না থেকেও তিনি কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে সভা, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজনে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তাঁরই নির্দেশনায় আওয়ামী লীগের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী ওইসব কর্মসূচী ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত ওইসব সভা-সেমিনারে গৃহীত প্রস্তাব ও সুপারিশগুলো যথাযথ বিবেচনায় নেন। জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্টের সদস্য সংগঠন, আজিজুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে আমি যখন উল্লেখ করি যে, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হয় না বললেই চলে এবং এর প্রতিবিধানে দেশের সকল থানা বা উপজেলায় সরকারী অর্থায়নে বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা যেতে পারে, তিনি তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তার নির্দেশনায় জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয় এবং আমি তার অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদকে কো-চেয়ার করে গঠিত শিক্ষানীতি কমিটিতে প্রতি উপজেলায় সরকারী অর্থায়নে বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে তা অনুমোদিত হয়। যদিও সে লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানো, তাদের পরীক্ষার ফল নিয়ে অভিভাবকদের অনাকাক্সিক্ষত প্রতিযোগিতা বন্ধ, প্রশ্ন ফাঁস, দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে কোন দেশের ছেলেমেয়েদের চেয়ে মেধায় কোন অংশে কম নয়, মেয়ে শিক্ষার্থীরা যে ছেলে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেÑ এসব নিয়ে খোলামেলা নিজমত প্রকাশে শেখ হাসিনা কখনও দ্বিধা করেন না। এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফল আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের সময়ও তাকে পাবলিক পরীক্ষার সময় কমিয়ে পড়াশোনার সময় সাশ্রয় করার পরামর্শ দিতে দেখা গেছে। তার সময়ের পরীক্ষা পদ্ধতির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা যখন পরীক্ষা দিয়েছি, তখন আমাদের দুই বেলা করে পরীক্ষা দিতে হতো। সকালে এক পেপার, বিকেলে এক পেপার। আমাদের দম ফেলার সময়ই থাকত না, সাতদিনে পরীক্ষা শেষ। ...১০টা সাবজেক্ট, মাঝখানে দুইদিন ছুটি ধরে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত।’ বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষার সময় কী করে কমানো যায়, তা খুঁজে দেখার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা যদি করতে পারেন, তাহলে দেখবেন, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে। পরীক্ষাটাও তাড়াতাড়ি হবে, আর এখানে ওই যে নানা ধরনের কথা অপপ্রচার, তার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে।’ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।’ যারা অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মনোবল না হারিয়ে পরবর্তী পরীক্ষার জন্য ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এখন থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়লে কৃতকার্য হবে। নিজের ইচ্ছায় পড়তে হবে।’ অভিভাবকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা পরামর্শ দেন, ‘ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করবেন না। কেন খারাপ করল, তা খুঁজে বের করুন।’ সরকারী কলেজ ও এমপিওবিহীন কলেজের ফল বিভিন্ন সরকারী কলেজের এবারের এইচএসসির ফল নিয়ে বিরূপ মতামত পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার কাছে নরসিংদীর সরকারী কলেজগুলোতে পরীক্ষার ফলে হতাশা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। নরসিংদী সরকারী কলেজে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী এসএসসিতে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪ জন। নরসিংদী সরকারী মহিলা কলেজ থেকে কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। শিবপুর সরকারী শহীদ আসাদ কলেজ থেকে এক হাজার ৫২১ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছে এক হাজার ৯৭ জন। অর্থাৎ এ কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়েছে। নরসিংদী সরকারী কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহানারা বেগম বলেন, কলেজের সর্বোচ্চ পাঠদান নিশ্চিতকরণে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কলেজটিতে সারাবছর উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীসহ বিভিন্ন পরীক্ষা থাকায় ও অন্যান্য জটিলতায় ক্লাস করানোর সুযোগ হয় না। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় খারাপ করছে। নরসিংদী সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ফল বিপর্যয়ে শিক্ষক হিসেবে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমাদেরও কিছুটা গাফিলতি আছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরাও ক্লাসমুখী না হয়ে কোচিংমুখী হচ্ছে। নরসিংদী সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়া বলেন, শিক্ষকদের যথাযথ তদারকি না থাকায় পর্যাপ্ত ক্লাস হচ্ছে না। প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের হুরুন্নেসা খাতুন চৌধুরী কলেজের শতভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এবারই এ জেলায় সবচেয়ে বেশি ফল খারাপ হয়েছে। ইংরেজী ও আইসিটিতে অধিকাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী খারাপ করায় এমন ফল বিপর্যয় হয়েছে বলে জানান শিক্ষকরা। তবে, অভিভাবকরা শিক্ষকদের দায়ী করছেন। তারা বলেছেন, নিয়মিত কলেজে ক্লাস না হওয়া এবং শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের মানসিকতার কারণে এ বিপর্যয় হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত না হলেও কলেজের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো না। প্রসঙ্গক্রমে এমপিও বঞ্চিত শিক্ষকদের একটি বেসরকারী কলেজের পরীক্ষার্থীরা কিভাবে শত ভাগ পাস করেছে তা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘শিক্ষকরা বেতন না পেলেও এইচএসসিতে শতভাগ পাস’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। পনেরো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কলেজেটির শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও নেই। তারপরও শিক্ষাকদের নিরলস চেষ্টায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে যশোরের চৌগাছা উপজেলার জিডিবি আদর্শ কলেজ। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় কলেজটির মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের ৮৫ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করেছে। এর মধ্যে মানবিক বিভাগের তিন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের শতভাগ পাস করা ছয়টি কলেজের মধ্যে একটি এই কলেজটি। এর আগে ২০১৬ ও ২০১০ সালে শতভাগ পাসের কৃতিত্ব দেখায় কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২০১৫ সালে ৯৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে। এছাড়া অন্যান্য বছরের ফলে কলেজটির শিক্ষার্থী ৮০ শতাংশের ওপরে পাস করেছে। এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্ত দুই শিক্ষার্থী শারমিন খাতুন ও হৃদয় হোসেন বলেন, আমাদের শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই আমরা এই ফল করতে পেরেছি। আমরা এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেলেও স্যারদের আন্তরিকতা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লেখাপড়া করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারেনি কেন- এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। . পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে ৫ জিজ্ঞাসা প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে আমার ৫টি জিজ্ঞাসা : ১. শিক্ষকের মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীকে যা পড়ানো হয়, প্রচলিত পরীক্ষায় তার যথাযথ মূল্যায়ন হয় কিনা? ২. শিক্ষার্থীকে যা পড়ানো হয় এবং সে যতটুকু অনুধাবন ও আত্মস্থ করতে পারে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কি তার ওপর ভিত্তি করে হয়, না সে যা বুঝতে সক্ষম হয় না তার ওপর ভিত্তি করেই হয়? ৩. ক্লাসে নিয়মিত পাঠগ্রহণকারী শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ করে কিভাবে ও কেন? তার দায় পাঠদানকারী শিক্ষকের ওপর কতটুকু বর্তায়? ৪. প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নে যে শিক্ষার্থী ভাল ফল করে পাবলিক পরীক্ষায় তার ফল খারাপ কিভাবে? তার জন্য কে দায়ী সে নিজে, না তার প্রতিষ্ঠান, না প্রচলিত পরীক্ষা ব্যবস্থা? ৫. এসব পরীক্ষা কি শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়নে সহায়ক? . পরীক্ষা নিয়ে ইউনেস্কোর প্রতিবেদন কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, লাও পিডিআর, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের পরীক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে ইউনেস্কো ২০১৭ সালে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এশিয়ায় শিক্ষা মূল্যায়ন অথবা পরীক্ষা ব্যবস্থায় কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে : ১. প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রতারণা ও দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। ২. আর্থিক প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করতে মা-বাবার প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। ৩. উচ্চতর স্তরে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর ওপর ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি করা হয়। ৪. পরীক্ষার কারণে সামাজিক আচরণে পরিবর্তন সূচিত হয়। ভর্তি পরীক্ষার সময় সকালের ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে কোরিয়ায় দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ১ ঘণ্টা পরে শুরু হয়। পরীক্ষায় সন্তানদের সাফল্য কামনায় মা-বাবারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা করেন। ৫. জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা যেমন তীব্র, গ্রামাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ তেমনি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তারপরও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, পরীক্ষা ব্যবস্থা দরিদ্র শিশুদের জীবন উন্নয়ন বা পরিবর্তনে সহায়ক। ৬. পরীক্ষায় ভাল ফলের ওপর সমাজ খুব বেশি গুরুত্ব দেয়। থাইল্যান্ডে সরকারী স্কুলের ওপর বাবা-মা ও শিক্ষার্থী উভয়ের আস্থা কম থাকায় পরীক্ষায় ভাল ফলের জন্য টিউটরের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও তার মূল্যায়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি ইউনেস্কো পরিচালিত উপরোক্ত গবেষণা আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত সংস্কারে কাজে আসতে পারে। . জাতীয় পরীক্ষানীতি অপরিহার্য এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীর মনে ভয়ভীতির উর্ধে, হতাশার পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সহায়ক জাতীয় পরীক্ষানীতি প্রবর্তন সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্পৃক্ত করে বিশেষ করে শিক্ষার্থী, তার শিক্ষক ও অভিভাবকের প্রত্যক্ষ কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকাশ্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে এ পরীক্ষানীতি তৈরি করতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষা, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি পরীক্ষা এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে জাতীয় পরীক্ষানীতির আওতায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত বিধি মোতাবেক কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে দেশ-বিদেশের পরীক্ষাসংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহ, পরীক্ষাবিষয়ক গবেষণা পরিচালনা ও কর্মসূচী গ্রহণ, অভ্যন্তরীণ ও পাবলিক উভয় পরীক্ষার দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের পর্যায় ও পালাক্রমিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কেন্দ্র স্থাপন এ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। শুধু নির্দেশ, নির্দেশনা নয়- সকল স্টেকহোল্ডারের অংশীদারিত্বে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে। পরীক্ষানীতির একটি বড় করণীয় হবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়তা প্রদান। পরীক্ষা যে শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়নের জন্য, পরীক্ষার জন্য শিক্ষা নয়- শিক্ষার মূল্যায়নের জনই পরীক্ষা, এ উপলব্ধি শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, নীতিপ্রণেতা, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সকলের চিন্তা চেতনায়, কথায় ও কাজে প্রতিফলিত হতে হবে। পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনার পরামর্শ তাদের পথ দেখাতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য [email protected]
×