ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক অবরোধ,শতাধিক যান ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ

বাসচাপায় রাজধানীতে ফের দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩০ জুলাই ২০১৮

 বাসচাপায় রাজধানীতে ফের দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। রবিবার দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে এই ঘটনার পর ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে শতাধিক যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এ সময় তারা গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়ক টানা দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখলে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ জানান, শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সড়ক যানচলাচল স্বাভাবিক হয়। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সগির মিয়া জানান, নিহতরা হচ্ছে, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক শাখার দ্বাদশ শ্রেণীর আবদুল করিম ওরফে সজীব এবং বিজ্ঞান বিভাগের একাদশ শ্রেণীর দিয়া খানম ওরফে মিম। সগির মিয়া জানান, গুরুতর আহত একজনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত আরও ১২ জন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে তারা আশঙ্কামুক্ত। কয়েকজনকে বাইরের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহত আব্দুল করিমের বাবার নাম মৃত নূর ইসলাম ও মা মহিমা বেগম। তাদের বাড়ি উত্তরা আশকোনা এলাকায়। আর নিহত দিয়া খানমের সহপাঠীরা জানিয়েছেন, দিয়ার বাড়ি মহাখালী দক্ষিণ পাড়ায়। তার বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম। মেয়ে দিয়া খানম মিমের দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবরেই ছুটে আসেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু হাসপাতালে এসে শোনেন ততক্ষণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে দিয়া। মরদেহের সামনে দাঁড়ানো বাবা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ধরে বাইরে বসানোর পর জ্ঞান ফেরে তার। এরপর জাহাঙ্গীর আলম বিলাপ করে বলেন, মেয়েকে কলেজে পাঠানোর পর থেকেই আমার খারাপ লাগছিল। এখন বুঝলাম কেন এমন হচ্ছিল। যদি আগে বুঝতাম এমন করে দুর্ঘটনায় আমার মেয়ে মারা যাবে তবে একা ফিরতেই দিতাম না। তিনি বলেন, আমার ইচ্ছের কবর হয়ে গেল। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে দিয়াই ছিল সবার ছোট। ওর ইচ্ছে ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হবে। কিন্তু ওর মৃত্যুতে সে ইচ্ছেরও মৃত্যু হলো। কলেজ থেকে বাসায় ফেরার আর অপেক্ষা শেষ হবে না। পাশেই কান্নায় অসুস্থ হয়ে পড়া দিয়ার বান্ধবী রূপা বলেন, এভাবে দিয়া চলে যাবে বুঝিনি। হাসিখুশি দিয়া ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্য, রবিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আবদুল্লাহপুর থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী জাবালে নূর পরিবহন লিমিটেডের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো ব-১১৯২-৯৭) চালক হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারান। এ সময় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর বাসটি উঠে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই আবদুল করিম ও দিয়া খানম ওরফে মিম নামে ওই দুই শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। গুরুতর আহত অবস্থায় এক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ঘটনাস্থলের পাশেই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ। ঘটনার সময় ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা র‌্যাডিসন ব্লু হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। অনেকে বাসের জন্য ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস এলে শিক্ষার্থীরা তাতে ওঠার চেষ্টা করে। সে সময় জাবালে নূর পরিবহনের আরেকটি বাস বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ওই দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে তাদের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা এসে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রায় শতাধিক কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে। এতে ঘটনাস্থলে ও এর আশপাশে বিমানবন্দর সড়কটিতে যানবাহন ভাংচুরের কাঁচে রাস্তা সয়লাব হয়ে যায়। এতে সেখানে থেকে যাওয়ার সময় শতাধিক মোটরসাইকেল ও গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন সংশ্লিষ্ট যানবাহনের চালকরা। পুলিশ জানায়, ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তানজিল, বিআরটিসি, ভূঁইয়া পরিবহন ও বেশ কয়েকটি প্রাইভেটকার ভাংচুর করে। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরে বিকেল সাড়ে ৩টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই বাসের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী আরিফুল ইসলাম জানান, ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনা। সব যেন দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল। কী থেকে কী হয়ে গেল। পেছন থেকে একটি বাসের যাত্রী রিপন বলেন, এমন ঘটনা আর কখনও দেখিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শুরু হয়ে ঘটে গেল আহাজারি। কান্নার আওয়াজ আর জটলা দেখেই বাস থেকে নেমে পড়ি। ওই ঘাতক জাবালে নূর বাসের কাছে যেতেই দেখি রক্তের ¯্রােত বইছে। দৌড়ে আসে অন্য ছাত্রছাত্রীরা। এ সময় দৌড়ে আসে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে সেনা কর্মকর্তা ও ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। তিনি বলেন, আমার দেখে মনে হলো, পেছনের বাসটি সামনের বাসটিকে আটকে দিতে চেয়েছিল। দ্রুতগতিতে টার্ন নিয়ে সামনে ঢুকতেই যাত্রীদের উপর উঠে পড়ে বাসটি। ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সজীব জানান, নিহত দুজনসহ মোট পাঁচজনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। বাকিদের সিএমএইচে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী জীবন জানান, কলেজ ছুটির পর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা বাসের জন্য এমইএস মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় মিরপুর থেকে আসা জাবালে নুর পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ওই শিক্ষার্থীদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই ওই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই কলেজ থেকে বেরিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রেডিসন হোটেলের সামনে থেকে বনানী উড়াল সেতু ও কালশী উড়াল সেতু এবং শেওড়া পর্যন্ত শতাধিক বাস ভাংচুর করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর ক্যামেরাও ভাংচুর করা হয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থী জীবন। তিনি জানান, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কাউকে ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনে ছবি কিংবা ভিডিও ধারণ করতে দিচ্ছে না। কয়েকজনের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাংচুর করা হয়েছে। গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল আহাদ জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। ঘটনাস্থল থেকে বাসচালক ও তার সহকারীকে (হেলপার) পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনার খবর পেয়ে কলেজটির শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও জনতা এ ঘটনায় ইসিবি চত্বরের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক বাস ভাংচুর করে। এতে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে সড়কটিতে যান চলাচল শুরু হয়েছে। ঘটনার পর ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাহান হক জানান, দুই শিক্ষার্থী নিহতের হওয়ার পর তাদের লাশ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের রাখা হয়েছে। ওই হাসপাতালে ১৪ জন আহত অবস্থায় ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে বেশ কয়েকটি গাড়ির ভাংচুর ও ঘাতক বাসটি অগ্নি সংযোগ করেছে। পরে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বিকেলে সাড়ে তিনটার দিকে রাস্তা সচল করা হয়েছে। এরপর র‌্যাকার এসে ভাংচুর করা গাড়িগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। দোষীদের শাস্তি পেতেই হবেÑ নৌমন্ত্রী ॥ এদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি পেতেই হবে। রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মোংলা বন্দরের কনটেনার লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে মোবাইল হারবার ক্রেন কেনা সংক্রান্ত চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
×