ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে এ ওষুধে

জালিয়াতির মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ রোসাইলাক-৩০০ বাজারজাত

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩০ জুলাই ২০১৮

 জালিয়াতির মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ রোসাইলাক-৩০০ বাজারজাত

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ মাতৃগর্ভে শিশুর প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ রোসাইলাক-৩০০ থেকে সাবধান। একটি অসাধুচক্র সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা এ ওষুধটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও তা ডাম্পিং করেনি। বরং কার্টনের গায়ে জালিয়াতি করে ৩ বছর ব্যবহারের মেয়াদ বাড়িয়ে বাজারে ছেড়েছে। এখন দেশের সব ফার্মেসিতেই এ ওষুধটি অবাধে বিক্রি হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এ ওষুধটি ব্যবহারে শত শত নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। জানা গেছে, সন্তান সম্ভবা যেসব মহিলার রক্তের আরএস কালচার স্বামীর সঙ্গে মিল পড়ে না অর্থাৎ গর্ভবতী মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় স্বামীর যদি পজেটিভ হয় তবে প্রসূতি মায়ের জীবিত ও সুস্থ সন্তান প্রসব নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই গর্ভেই সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এ রোগীর রোসাইলাক-৩০০ (৩০০ এমসিজি) ইনজেকশন দিয়ে থাকেন। এ ওষুধটিই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গর্ভজাত শিশুদের জীবনরক্ষায় সহায়তা করে। দুর্লভ এ ওষুধটি সুইজারল্যান্ডের CSL BEHRING AG কোম্পানি উৎপাদন করে থাকে। তাদের এ ওষুধটি বিভিন্ন দেশ আমদানি করে চিকিৎসা সেবায় ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও এ ওষুধটি ১২৮ নিউইস্কাটন রোডের হাবিব সেন্টারের (৩য় তলা) ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি বাংলাদেশ লিমিটেড আমদানি করে বাজারজাত করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানটি মেয়াদোত্তীর্ণ জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধটি জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবহার মেয়াদ বাড়িয়ে বাজারে ছেড়েছে। আইটি ব্যবসায়ী মোঃ মনোয়ার হোসাইন রোসাইলাক-৩০০ ইনজেকশনটি কেনার পর মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি দেখেন ওষধের কার্টনের এক জায়গা কৌশলে ঘষা মাজা করা হয়েছে। তার পরেই ডোম নং-০১২০১৮, লট নং-৪৩৭০৫০০০১৮, ব্যবহারের মেয়াদ ১২ ডিসেম্বর ২০২০ ছাপানো হয়েছে। জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধটি উত্তীর্ণ তারিখ নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ হলে এরপর অনুসন্ধান চালানো হয়। ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী পাবনার বড় বড় ফার্মেসিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় সব জায়গাতে একই কার্টনের ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। আর প্রত্যেকটি ওষুধেরই কার্টনে ঘষা মাজা করা হয়েছে। আর প্রত্যেকটিরই মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেখানো হয়েছে ২০২০ সাল। এরপর ওষুধের বারকোড স্ক্যান করলে তখন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির মাধ্যমে এ ওষুধটির মেয়াদ বাড়ানোর পৈশাচিক ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। সুইজারল্যান্ডের CSL BEHRING AG কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্যে জানা যায়, রোসাইলাক-৩০০ ওষুধটির উৎপাদন তারিখ-২২ জুন ২০১২। আর মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১৭। ডোম নং- ০১২০১৮। লট নং- ৪৩৭০৫০০০১৮। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি বাংলাদেশ লিমিটেডের কার্টন তথ্যে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডের ঈঝখ ইঊঐজওঘএ অএ কোম্পানির উৎপাদনের তারিখ, ডোমকোড, ব্যাচ নাম্বার সব মিলে গেলেও শুধু ওষুধটির ব্যবহার মেয়াদ ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ২-৩ দিন ধরে এ নিয়ে বারবার যোগাযোগ করলে তারা জানান, এটা আমাদের বিষয় নয়, এটি উৎপাদনকারী সুইজারল্যান্ড প্রতিষ্ঠানের ব্যাপার। এ ব্যাপারে তাদের কিছু বলার নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজারজাতকরণের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, বারকোড ভুলের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। সুইসভাষা না বুঝার কারণে এ ভুলটি হয়েছে বলে তিনি জানান। ওষুধের ক্রেতা মোঃ মনোয়ার হোসাইনকে তিনি বারবার অনুরোধ করে বলেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে নতুন লটের মাল আপনাকে পৌঁছে দিব। শুধু তাই নয় তাকে আকার ইঙ্গিতে টাকা দেয়ার জন্যও তার ঠিকানা জানতে চান। মনোয়ার হোসাইন এ ব্যাপারে তাকে কড়া মেজাজে জানান, আপনারা শিশুর জীবন নিয়ে একই ব্যবসা করছেন। এ ওষুধটিও যে আপনাদের আসল তার প্রমাণ কী? প্রতিষ্ঠানটির এমডি অনুনয় বিনয় করে জানান, সারা দেশ থেকেই ওষুধটি তুলে নেয়া হবে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানিয়েছেন, রোসাইলাক ইনজেকশন শিশুর জীবনদানকারী ওষুধ বলা হয়। এ ওষুধটি যদি ভেজাল বা কার্যকর না থাকে তাহলে গর্ভবতী মায়ের গর্ভেই সন্তান নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। এ ওষুধটি ভেজাল হলে প্রথম ইস্যুর সন্তান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা যেমন থাকে তার চেয়ে বেশি আশঙ্কা তৈরি হয় দ্বিতীয় ইস্যুতে। দ্বিতীয় ইস্যুতে মৃত সন্তান জন্ম দেয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে থাকে। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ এ ওষুধটি ব্যবহারে শত শত শিশুর প্রাণ কেড়ে নিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। এ ব্যাপারে আইটি ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসাইন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানান, মাতৃগর্ভের শিশু জীবনরক্ষাকারী এ ওষুধটি মেয়াদোত্তীর্ণের পর যারা জালিয়াতি করে ব্যবহার উপযোগী দেখিয়ে বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে তাদের কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। তিনি এদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। মেয়াদাত্তীর্ণ এ ওষুধ প্রয়োগে ইতোমধ্যে যে শত শত শিশু মায়ের গর্ভেই মারা যায়নি তার নিশ্চয়তা কে দিবে। তিনি এদের শিশু হত্যাকারী আখ্যা দিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
×