ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাজুড়ে পারফর্মেন্স আর্ট

অন্যায় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাধারণের শিল্পভাষা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৩০ জুলাই ২০১৮

অন্যায় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাধারণের শিল্পভাষা

মোরসালিন মিজান ॥ শিল্পের নানা মাধ্যমেই কাজ হচ্ছে এখন। নিরীক্ষা চলছে। সে তুলনায় পারফর্মেন্স আর্ট অনেক কম হয়। বাংলাদেশে পারফর্মেন্স আর্ট। একটু, হ্যাঁ, নতুন মিডিয়া। পাশ্চাত্যে ৬০-এর দশকে শুরু। বাংলাদেশে ৮০-এর দশকে। এরপর সারা বিশ্বে প্রসার ঘটলেও এ দেশে তেমন এগোয়নি। তবে পারফর্মেন্স আর্ট অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অভিনবত্ব আছে। খুব সহজেই সাধারণের কাছে পৌঁছা যায়। পরিবেশনা নয় শুধু, সুনির্দিষ্ট বক্তব্য থাকে। সব মিলিয়ে শিল্পের আলোচনায় স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে পারফর্মেন্স আর্ট। হয়ত তাই মাধ্যমটি নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেছে শিল্পকলা একাডেমি। এর অংশ হিসেবে অতি সম্প্রতি শহর ঢাকা ঘুরে বেড়িয়েছেন ১৫ শিল্পী। একেকজন পারফর্মেন্সের জন্য একেক বিষয় বেছে নিয়েছিলেন। তারপর রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বসে পারফর্ম করেন তারা। এভাবে সমাজ রাষ্ট্র রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা। বহু মানুষ কৌতূহলী চোখে তাদের পরিবেশনা দেখেন। উপভোগ করেন। একটা নতুন দোলা যেন দিতে সক্ষম হন শিল্পীরা। তিন দিনব্যাপী আয়োজনের শুরুটা হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার। শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত চত্বরে পরিবেশনার শুরু। শিল্পী সুমনা আক্তারের পরিবেশনার বিষয় ছিল ‘স্ক্রিম।’ বেদম চিৎকার করে আশপাশের এলাকার নীরবতা ভাঙেন তিনি। কিন্তু কেন? এর অর্থ আসলে কী? পরিবেশনার মাধ্যমে শিল্পী জবাব দেন। বলতে চান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলো। সরব হও। প্রতিবাদ কর। শিল্পী সুজন মাহাবুব মন দেন নিবিড় ‘অন্বেষণে।’ মানুষ ও সময়কে বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন তিনি। শিল্পকলা একাডেমি থেকে হেঁটে চলেন টিএসসি শাহবাগের দিকে। মানুষের চোখের দিকে তাকান। ভাষাটি পড়ার চেষ্টা করেন। হাতে ছিল ভিডিও ক্যামেরা। সেটিও সচল। মানুষের ছবি ধারণ করে চলে। এভাবে নানা রঙের মানুষের চোখের ভাষা, মনের গতি বোঝার চেষ্টা করেন শিল্পী। আবু নাসের রবি বের হয়েছিলেন সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে। মাথার ওপর সাদা রঙের ছাতা। আর এক হাতে বাঁশি। বাঁশিতে সুর তুলতে তুলতে টিএসসি থেকে শাহবাগের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। আত্মিক আনন্দের উপলব্ধি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তার এমন পরিবেশনা। শিল্পী সঞ্জয় চক্রবর্তী তার পারফর্মেন্সে স্মরণ করেন জঙ্গীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া লেখক অভিজিৎ রায় কে। মুক্তমনা লেখকের রক্ত লেগে আছে যেখানে, সেখানেই ছিল পরিবেশনাটি। জাদুঘরের সামনে ছিলেন শিল্পী অসীম হালদার সাগর। ‘সামটাইমস, সামথিংস অ্যাবাউট নাথিং’ শিরোনামের পরিবেশনায় নিজে বলেননি শুধু, দর্শককে সম্পৃক্ত করেছেন। দ্বিতীয় দিন শিল্পী ফারাহ নাজ মুন যানজট ঠেলে চলে যান পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে। পরিবেশনার জন্য ঐতাহিসক লালকুঠিকে বেছে নেন তিনি। আলো জ্বেলে কুঠিরের অলিগলি ঘুরে বেড়ান। বিগত দিনের ভুলে যাওয়া ইতিহাস, পুরনো মানুষের স্মৃতি স্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গল্প খুঁজে বেড়ান তিনি। একইদিন শিল্পী শুভ সাহা ছিলেন শ্যাম বাজার ঘাটে। জলে নেমে পারফর্ম করেন তিনি। শিল্পী জয়দেব রোয়াজা নিজের শরীরে কালো রং মেখে নেন। দূষণের নগরী ঢাকাকে তুলে ধরতেই এমনতর সাজ তার। বাংলাবাজারের ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংয়ের কাছাকাছি জায়গায় পারফর্ম করেন তিনি। শিল্পী অর্পিতা সিংহ লোপা আবার গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন সোনালি কাপড়। এ পোশাকে পুরনো ঢাকার সোনালি অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরেন। শিল্পী জুয়েল এ রব নিজেবে চটের বস্তায় বন্দী করে অভিনব শিল্পভাষা নির্মাণ করেন। অবলোকন করেন পথচারীদের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। সরকার নাসরিন টুনটুন তার পারফর্মেন্সে তুলে ধরেন পরিবেশপ্রেমের কথা। শেষদিনটি ছিল বৃষ্টি বিঘিœত। এদিন শিল্পীদের প্রায় সকলেই সমবেত হয়েছিলেন মানিক মিয়া এভেনিউতে। নিজেদের পরিবেশনা দিয়ে দর্শনার্থীদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। ফারহানা আক্তারের পরিবেশনাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঢাকার শব্দ দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন তিনি। সহশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে চমৎকার পারফর্মেন্স। বহু মানুষ কৌতূহলী চোখে দেখছিলেন। এভাবে অন্যরকম তিনটি দিন। একেবারে আলাদা করে বলার মতো। মনে রাখার মতো। আয়োজন প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, পারফর্মেন্স আর্ট দিয়ে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে চাই। এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের ১৮তম আসরে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে এই শিল্প মাধ্যম। প্রথমবারের মতো মাধ্যমটিকে যুক্ত করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ নিয়ে সৃজনশীল কাজ হবে বলে জানান তিনি। শিল্পীরাও খুশি কাজ করতে পেরে। কথা হচ্ছিল ফারহানা আক্তারের সঙ্গে। প্রবাসে বহু দিন কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি। বললেন, ঢাকার রাস্তায় নেমে আমি হাসিমুখ দেখিনি তেমন। সবার মুখে বিরক্তি। গুমরা মুখ। যানজট শব্দ দূষণ ইত্যাদির কারণে এমন অবস্থা। আমি পারফর্মেন্স আর্টের ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছি। প্রতিকার চেয়েছি। ভবিষ্যতেও কাজ করতে চান বলে জানান তিনি।
×