ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তৃতীয় ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার ১৮ রানে

তামিমের রেকর্ডে সিরিজ জয়

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৯ জুলাই ২০১৮

তামিমের রেকর্ডে সিরিজ জয়

রুমেল খান ॥ কে না জানে, ওয়ানডে ক্রিকেটে কোন দল যদি জিততে চায় তাহলে তাদের টস জেতা এবং আগে ব্যাট করে লড়িয়ে বা বড় পুঁজি সংগ্রহ করাটা জরুরী-আবশ্যিক কর্তব্য। দুটি কাজই সফলভাবে করেছিল বাংলাদেশ দল। বাকি ছিল তৃতীয় এবং আসল কাজটি। নিয়ন্ত্রিত বোলিং এবং ক্ষুরধার বোলিং দিয়ে সেটিও সফলভাবে করে ফেলে লাল-সবুজ বাহিনী। দারুণভাবে তারা ম্যাচটা জিতে যায় ১৮ রানে (৫০ ওভারে বাংলাদেশের ৬/৩০১ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ৫০ ওভারে ৬/২৮৩)। ফলে তারা প্রমাণ করল সেই চিরন্তন প্রবাদটি, ‘ওয়ানডে ক্রিকেটে ম্যাচ জেতায় ব্যাটসম্যানরা’। কারণ রানের একাউন্টে বড় সংগ্রহ না থাকলে ভাল বোলিং করেও শনিবার সেন্ট কিটস্রে ওয়ার্নার পার্কে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এবং শেষ একদিবসীয় এই ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এই জয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিল বঙ্গ শার্দুলরা। এটা তাদের সার্বিকভাবে ২৩তম, দ্বি-পাক্ষিকভাবে ২২তম, বিদেশের মাটিতে ষষ্ঠ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তৃতীয় সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব। এর আগে তারা দুবার ক্যারিবীয়দের হারিয়েছিল ২০০৯ সালে ৩-০ এবং ২০১২-১২ সালে ৩-২ ব্যবধানে। তাছাড়া নয় বছর পর ঘরের বাইরে সিরিজ জেতার স্বাদও পেল স্টিভ রোডসের শিষ্যরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য স্বাগতিকদের প্রয়োজন ছিল ২৮ রানের। কিন্তু প্রাণপণে চেষ্টা করেও মাত্র ৯ রানের বেশি করতে পারেননি পাওয়েল-নার্স জুটি। চমৎকার বোলিং করে জয় নিশ্চিত করেন বোলার ‘কাটার মাস্টার’ মোস্তাফিজুর রহমান। জয় শেষে উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। শনিবারের ম্যাচে মুদ্রা নিক্ষেপের ভাগ্য-লড়াইয়ে জেতেন মাশরাফি মুর্তজা (সিরিজে টানা তৃতীয়বারের মতো)। ব্যাটিং-সহায়ক উইকেট হলে যা করা উচিত, বুদ্ধিমানের মতো সেটাই করেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। বেছে নেন উইলোবাজি। তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সঠিক প্রতিপন্ন করেন ব্যাটসম্যানরা। তবে শুরুটা বাংলাদেশ দল করে কিঞ্চিৎ ধীরগতিতে। প্রথম ১০ ওভারে রান তোলার গতি ৪-এর কম ছিল। তাছাড়া উদ্বোধনী উইলোবাজ এনামুল হক বিজয় ক্রিজে টিকে থাকতে পারেননি বেশিক্ষণ। ৩১ বলে মাত্র ১০ রান করে জেসন হোল্ডারের বলে যখন কাইরন পাওয়েলের হাতে ধরা পড়ে সাজঘরের পথ ধরেন, তখন দলের সংগ্রহ মাত্র ৩৫ (৯.৩ ওভারে)। আগের দুই ম্যাচের ফর্ম এই ম্যাচেও ধরে রেখেছেন তামিম। শেষদিকে তুফান বইয়ে দেন তোলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তাদের দুজনের উইলোতেই ভর করেই মূলত বড় স্কোর গড়া সম্ভব হয় বাংলাদেশ দলের। ম্যাচে ফেরা যাক। আগের দুই ম্যাচের রানের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেও। তামিমের সঙ্গে সাকিব আল হাসান আবারও গড়েন বড় রানের জুটি। তামিম ছিলেন কিছুটা শান্ত। আর সাকিব ছিলেন চঞ্চল, মানে স্কোরবোর্ড সচল রাখা ব্যাটিং। এর প্রমাণ মাত্র ১৬ ওভার ব্যাট করে এই জুটির সংগ্রহ ৮১ রান, যা বেশ আশাব্যঞ্জকই। টানা তৃতীয় অর্ধ শতকের সুযোগ নষ্ট করেন সাকিব। টপ এজ হয়ে স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন কেমো পলের হাতে। গোলকবাজ ছিলেন এ্যাশলে নার্স। আউট হওয়ার আগে সাবলীল ব্যাটিংয়ে ৩ বাউন্ডারির সাহায্য করেন ৩৭ রান (৪৪ বলে)। দলের রান তখন ২৫.৩ ওভারে ২/১১৬। বন্ধু-সহযোদ্ধা সাকিবকে হারালেও মুষড়ে পড়েননি তামিম। হারাননি আত্মবিশ^াসও। ফলে কিছুক্ষণ পরেই ক্যারিয়ারের ৪৩তম অর্ধশতক পূরণ করতে কোন সমস্যা হয়নি ২৯ বছর বয়সী চট্টলার এই তরুণের। এরপরেই মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে জুটি গড়তে মনোযোগী হন তিনি। শুরুটা দারুণ করেন এই উইকেটরক্ষক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জলদিই তাকে ফিরতে হয় প্যাভেলিয়নে। ‘বিজাতীয়’ এক শট (স্কুপ শট) খেলতে গিয়ে নার্সের বলে বোল্ড আউট হন মাত্র ১২ (১৪ বলে) রান করে। তার ব্যাট থেকেই আসে ইনিংসের প্রথম ছক্কাটি। দলীয় সংগ্রহ তখন ৩১.১ ওভারে ৩/১৫২। আর মাত্র ২০টি রান করলেই মুশফিক একটি মাইলফলক স্পর্শ করতে পারতেন। ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র ষষ্ঠ উইকেটরক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ রানের তালিকায় পেছনে ফেলতেন ইংল্যান্ডের সাবেক উইকেটরক্ষক এ্যালেক স্টুয়ার্টকে। মুশফিককে হারিয়ে যতটা বিচলিত হয়েছিলেন, চতুর্থ উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহকে পেয়ে ততটাই যেন নির্ভার হন তামিম। বেড়িয়ে আসেন রক্ষণাত্মক খোলস করে। আরম্ভ করেন এগ্রেসিভ সব স্ট্রোক খেলা। টানা দুই বাউন্ডারিতে খুব দ্রুতই পৌঁছে যান ৮০’র ঘরে। জাগিয়ে তোলেন আরেকটি শতকের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। একটু পরে নব্বইয়ের ঘরে ঢুকে ৯২ থেকে এক ছক্কায় পৌঁছে যান ৯৮-তে। তবে বাকি দুই রান করতে কোন ঝুঁকি নেননি বা পাগলামি করেননি। আয়েশ করেই একে একে দুটি সিঙ্গেলস নেন। সেই সঙ্গে পূরণ করেন তুলে নেন ক্যারিয়ারের একাদশ ও চলতি সিরিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ১২০ বলে। তবে সেঞ্চুরির পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি বাঁ-হাতি এই ওপেনার। ব্যক্তিগত ১০৩ রানের মাথায় দেবেন্দ্র বিশুর বলে মিড উইকেটে পাওয়েলের হাতে ধরা পড়েন তিনি। শতকধারী ও দলের পক্ষে সর্বোচ্চ সংগ্রাহক তামিম খেলেন ১২৪ বল। তাতে ছিল ৭টি বাউন্ডারি এবং ২টি ওভার বাউন্ডারি। তিন ম্যাচে দুই শতক এবং এক অর্ধশতকে ২৮৭ রান করে তামিম গড়েন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচ সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ভেঙ্গে দেন ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই গড়া দিনেশ রামদিনের ২৭৭ রানের রেকর্ড। আরও আছে। তিন ম্যাচের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সফরকারী দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েন তামিম। রেকর্ডবুক থেকে মুছে দেন অস্ট্রেলিয়ার ড্যারেন লেম্যানের (২০৫) নামটি। প্রথম ওয়ানডেতে তামিম খেলেছিলেন ১৩০ রানের অপরাজিত ইনিংস। দ্বিতীয় ম্যাচে করেন ৫৪ রান। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পর চতুর্থ দেশ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও দুই সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তামিম। তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান এখন তারই। ১৮২ ওয়ানডেতে ১৮০ ইনিংসে ব্যাট করে তামিমের সংগ্রহ ৬৩০৫ রান। সর্বোচ্চ ১৫৪, গড় ৩৬.২৩। হাফ সেঞ্চুরি ৪২টি। তামিম যখন ফিরে যান, তখন বাংলাদেশের স্কোর ৩৮.৫ ওভারে ৪/২০০। এরপর সবাইকে ‘সারপ্রাইজ’ দিয়ে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন লোয়ার অর্ডার থেকে নিজেকে মিডল অর্ডারে প্রমোশন দেয়া মাশরাফি! তার এই সারপ্রাইজ বৃথা যায়নি। ১৪৪ স্ট্রাইকরেটে ঝড় তোলেন তিনি। তার অমন ব্যাটিং তা-বে সুবিধেই হয় অপর প্রান্তে থাকা মাহমুদউল্লাহর। বেশ নির্ভারচিত্তেই খেলতে থাকেন তিনি। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের এক ওভারেই হাঁকান পরপর তিন বাউন্ডারি। হোল্ডারের পরের ওভারেই লং অনের ওপর দিয়ে মারেন এক ছক্কা (দলের সাত ছক্কার তিনটিই আসে তার ব্যাট থেকে)। রিয়াদ-মাশরাফির জুটিতে নিমিষেই আড়াইশ’র কোঠা পেরিয়ে যায় বাংলাদেশের সংগ্রহ। এই জুটি মাত্র ৪২ বলে করে ৫৩ রান। অবশ্য আড়াইশ’র একটু বাদেই খতম হয়ে যায় ‘ম্যাশ’-এর ইনিংস। ২৫ বলে ৪ চার এবং ১ ছক্কার মারে ৩৬ রান করে ফেরেন তিনি। দলের সংগ্রহ তখন ৪৫.৫ ওভারে ৫/২৫৩। মাশরাফি চলে গেলেও বেশ ভালভাবেই হাল ধরে এক প্রান্ত আগলে রাখেন মাহমুদউল্লাহ। এদিকে সøগ ওভার বিধায় ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয় সাব্বির রহমান। খুব একটা মন্দ করেননি সম্প্রতি এক ভক্তকে ফেসবুকে হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসা সাব্বির আহমেদ। ৯ বলে ২ চারে ১২ রান করেন তিনি। শেলডন কর্টেলের বলে এভিন লুইসের হাতে ধরা পড়েন তিনি। দলের সংগ্রহ তখন ৪৮.৪ ওভারে ৬/২৭৯। অবিচল রিয়াদ খানিক বাদেই তুলে নেন ক্যারিয়ারের ১৯তম অর্ধশতক। দায়িত্ব নিয়ে চমৎকার ফিনিশিং করেন। সেই সঙ্গে থেকে যান নট আউট-ও। তার কল্যাণেই ৩০০ পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। রিয়াদ করেন ৬৭ রান (৪৯ বলে ৫টি বাউন্ডারিসহ)। তবে স্ট্রাইকরেটে (২২০) সবাইকে ছাড়িয়ে যান মোসাদ্দেক হোসেন। ৫ বলে এক চারের মারে ১১ রানের হার না-মানা ছোটখাট এক ‘খ-প্রলয়’ সৃষ্টি করেন তিনি। শেষের দশ ওভারে বাংলাদেশ সংগ্রহ করে ৯৬ রান। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ৫০ ওভারে ৬/৩০১ রানে। এটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড বাংলাদেশের। এর আগের রেকর্ডটি ছিল ৬/২৯২ রানের (২ ডিসেম্বর, ২০১২, ভেন্যু-খুলনা)। স্বাগতিকদের পক্ষে দুটি করে উইকেট নেন নার্স এবং হোল্ডার। কর্টেল এবং বিশু লাভ করেন ১টি করে উইকেট। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে ৬/২৮৩ রানের বেশি তুলতে পারেনি স্বাগতিক দল। অপরাজিত ৭৪ রানের ইনিংস খেলেও এবং করে দলের পক্ষে টপ স্কোরার হয়ে দলকে জেতাতে পারেননি রোভম্যান পাওয়েল। ওপেনার ক্রিস গেইল করেন হাফ সেঞ্চুরি (বল-৬৬টি, ৪-৬, ৬-৫)। অর্ধশতক করেন উইকেটরক্ষক শাই হোপ-ও (৬৪)। এছাড়া উল্লেখযোগ্য সংগ্রাহক ছিলেন শিমরন হেটমায়ার (৩০)। টেস্ট সিরিজে ধবল ধোলাই (২-০) হওয়ার যে যন্ত্রণা পেয়েছিল, এই ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর সেই যন্ত্রণার নিশ্চয়ই উপশম হবে বাংলাদেশের।
×