ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২৯ জুলাই ২০১৮

সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক

মধ্যবিত্ত জীবন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে, নিত্যনতুন সঙ্কট মোকাবেলা করেই পার হয়। আর নিরাপদে জীবন কাটানোর জন্য মধ্যবিত্তের বিনিয়োগের স্থলই হলো সঞ্চয়পত্র। এর আগে করারোপ ও নানা রকম সমস্যাকে কেন্দ্র করে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আর স্বাভাবিকভাবেই তখন এ পরিস্থিতিতে ধস নেমেছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। কিন্তু পরে মুনাফার হার বাড়ানোর ফলে সবাই ঝুঁকে পরেন সঞ্চয়পত্রের দিকে। বর্তমান সময়ে বাজেট ঘোষণার পর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হতে পারে, অর্থমন্ত্রীর কথা থেকে এমনই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এ কারণে ভাল মুনাফা থাকতে থাকতেই অনেকেই জমানো টাকা দিয়ে কিছু সঞ্চয়পত্র কিনতে ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরগুলোতে ভিড় শুরু করে। তড়িঘড়ি করে সঞ্চয়পত্র কিনতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র কেনার লাইন। বর্তমান অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমতে পারে এমন আতঙ্ক থেকেই সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা ভাল নয়। শেয়ারবাজারে বরাবরের মতোই আস্থাহীনতা চলছে। আর ব্যাংকে টাকা রেখে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগেই স্বস্তিদায়ক সাধারণ মানুষের কাছে। এমনকি বেশি মুনাফার লোভে কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন বলেও শোনা যায়। নতুন সুদহার কার্যকর হওয়ার আগে সঞ্চয়পত্র কিনলে বর্তমানের নির্ধারিত হারেই সুদ পাবেন গ্রাহকরা। গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির দীর্ঘ সারি একটি সাধারণ দৃশ্য। মাস শেষে বিনিয়োগের যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাও রীতিমতো অবাক করা। গত মে মাসে সঞ্চয়পত্রসহ সবধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ এসেছে সাত হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, যা দেশের সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এর আগে একক মাস হিসেবে সঞ্চয়পত্রের নিট ঋণের রেকর্ড ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে এ খাতের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ১০ হাজার ৯৩০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরগুলোর মাধ্যমে। এর মধ্য থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধ করে নিট ঋণ দাঁড়ায় সাত হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। এ নিয়ে সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) এ খাতের নিট ঋণ দাঁড়াল ৪৭ হাজার ৮৬১ কোটি টাকায়। তবে ওই সময়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৭৭ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার। এর মধ্য থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ২৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফা গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়। এর পরও এর প্রতিটি স্কিমের মুনাফার হার ১১ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বর্তমানে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ১১.২৮ শতাংশ এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১.০৪ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক আমানতের সুদের তুলনায় অনেক বেশি মুনাফা থাকায় কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে চলেছে। মূলত সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা দেয়ার জন্য সরকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এ প্রকল্প চালু করে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের এ মুনাফা অধিকাংশ ভোগ করছে সমাজের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ কারণেই সঞ্চয়পত্রের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তবে নিম্নবিত্তের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নীতিমালায় পরিবর্তন আনলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সেদিকটি সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থিতিশীলতা না থাকায় ব্যাংকগুলোয় হাজার হাজার কোটি টাকার তারল্য সৃষ্টি হয়েছে। ঋণে সুদের হার কমিয়েও বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় সঞ্চয়পত্র ও সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়ছে।
×