ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পণ্য আমদানির ঋণপত্র জাতীয় বাজেটকেও ছাড়িয়ে গেল

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ২৯ জুলাই ২০১৮

পণ্য আমদানির ঋণপত্র জাতীয় বাজেটকেও ছাড়িয়ে গেল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৫৪০ কোটি ৪৬ লাখ (৬৪.৪০ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হারে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা; যা চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও প্রায় লাখ কোটি টাকা বেশি। এলসি খোলার এই পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে এমন উল্লম্ফন আগে কখনও দেখা যায়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৪ হাজার ৪১১ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল; প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের মতো। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের আমদানি বাড়ায় এলসি খোলার পরিমাণ বাড়া স্বাভাবিক। কিন্তু খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের এলাসি খোলার পরিমাণ যে ‘অস্বাভাবিক’ হারে বেড়েছে তাতে ভোটের বছরে বিদেশে অর্থ পাচারের সন্দেহও জোরালো হয়ে উঠেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষ হয়েছে প্রায় এক মাস হতে চলল, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সব শেষ প্রকাশ করেছে মে মাসের হালনাগাদ তথ্য। চলতি বছরের ১১ মাসের তথ্যে দেখা যায়, এই সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চাল আমদানির জন্য। ২০১৭ সালে বন্যায় ফসলহানির কারণে চাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে আনা হয়েছিল। আর এই সময়ে চাল আমদানির এলসি বেড়েছে ২১১০ শতাংশ। এছাড়া গমের এলসি ৩৫ শতাংশ, পেঁয়াজে ৯০ শতাংশ, জ্বালানি তেলে ৪৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসির পরিমাণ ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। কেন আমদানি বাড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের জন্য সরঞ্জাম আমদানি সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির উল্লম্ফনে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানিও ‘অস্বাভাবিক হারে’ বেড়েছে। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক সময়ই আমরা শুনি যে, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। অনেক সময় শূন্য কন্টেনারও আসছে। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে। আহসান এইচ মনসুর আহসান এইচ মনসুর সে কারণে আমদানির এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে খানিকটা ‘উদ্বিগ্ন’ বলেও জানালেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান মনসুর। আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারের একটি পথ হচ্ছে ওভার ইনভয়েস দেখানো। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য বা অন্য পণ্য আনা হয় কখনও কখনও। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে আহসান মনসুর বলেন, একটা দিক দিয়ে এতদিন আমরা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিলাম। রিজার্ভ প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু আমদানি বাড়ায় সেটা আর থাকছে না। আকুর বিল পরিশোধের পরপরই রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল। আহসান মনসুর বলেন, আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বাড়ছে ধীরগতিতে। রফতানি আয় ও রেমিটেন্স যদি একই হারে বাড়ত তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। উল্লেখ্য, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
×